চলতি বছরই দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমঘন শিল্প পোশাক খাতের রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে বলে প্রক্ষেপণ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিল্পের ভবিষ্যেক আরো সুসংহত ও টেকসই করতে সার্বিক দক্ষতা উন্নয়ন প্রয়োজনও মনে করছেন তারা। এ পর্যায়ে পোশাক শিল্পের অপচয়, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্প উন্নয়ন ও জ্বালানি দক্ষতা নিয়ে বণিক বার্তার ধারাবাহিক প্রতিবেদন পর্ব ৩
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস ও আমদানীকৃত তেলের শীর্ষ ব্যবহারকারীদের একটি হলো বস্ত্র ও পোশাক খাত। আবার অদক্ষ ব্যবহারের কারণে দেশের মোট জ্বালানি অপচয়েরও অন্যতম খাত এটি। পরিসংখ্যান বলছে, অদক্ষ ব্যবহার ও অব্যবস্থাপনার কারণে এখনো বিপুল পরিমাণ জ্বালানির অপচয় হয়। এতে একদিকে জ্বালানির ওপর চাপ যেমন বাড়ছে, তেমনি পণ্য উৎপাদন ব্যয়ও বেশি হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানার কথা উল্লেখ করা যায়। ছয়তলা ভবনবিশিষ্ট কারখানাটিতে সর্বোচ্চ প্রযুক্তির জ্বালানি দক্ষ বয়লার স্থাপন করা হয়েছে। তবে এটির অবস্থান ভবনের নিচতলায়। অন্যদিকে কারখানায় তৈরি পোশাক আয়রন করার টেবিল স্থাপন করা হয়েছে পাঁচতলায়। বিজ্ঞানের খুব সাধারণ সূত্র থেকে এটা বোঝা যায় যে নিচতলা থেকে পাঁচতলায় স্টিম নেয়ার ক্ষেত্রে গ্যাসের চাপ বেশি প্রয়োজন হয় বলে অতিরিক্ত গ্যাস খরচ হয়। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনের দুর্বলতা হিসেবেই চিহ্নিত করছেন।
কেবল যে পোশাক শিল্প কারখানাতেই জ্বালানির অপচয় ঘটছে, বিষয়টি তা নয়। এ শিল্পের কাঁচামাল সুতা-কাপড়ের ডায়িং কারখানাগুলোতেও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনের ক্ষেত্রে একই ধরনের দুর্বলতার কথা জানা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দুর্বলতা আরো বড় রূপ নিচ্ছে দক্ষ ব্যবস্থপনার ঘাটতির কারণে। সম্প্রতি দেশে জ্বালানির দক্ষ প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন বা নকশার ত্রুটি ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা রয়েছে। অন্যদিকে প্রাপ্যতার অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে জ্বালানির দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে। ফলে ক্রমবিকাশমান বস্ত্র-পোশাক শিল্পের দক্ষ জ্বালানি ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাসান মোহাম্মদ মোস্তফা আফরোজ বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের বস্ত্র ও পোশাক শিল্পে জ্বালানির প্রচুর ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু জ্বালানি অপচয় কমানোর ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত বা যে ধরনের ব্যবস্থাপনা করা উচিত, সেখানে ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনের ত্রুটি তো রয়েছেই। এসব দূর করার জন্য উদ্যোক্তা বা কারখানা মালিকদের সদিচ্ছাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ। এছাড়া কারখানায় যে প্রকৌশলীরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন, তাদের জ্ঞান সময়ের সঙ্গে হালনাগাদ করার ওপরও জোর দেন তিনি। এজন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণেরও পরামর্শ দেন তিনি।
একটি কারখানাকে জ্বালানি দক্ষ করতে গেলে বেশ বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। বস্ত্র শিল্প মালিকরা বলছেন, এ খাতের জ্বালানি ব্যবস্থা বেশ দক্ষ। এর পরও দুই ধরনের অপচয়ের সুযোগ থেকে যায়। কারণ কোনো ব্যবস্থার মাধ্যমেই সর্বোচ্চ দক্ষতা পাওয়া যায় না। স্বাভাবিকভাবেই কিছু ত্রুটি থাকে, পরিচালনগত সমস্যা থাকে। তাত্ত্বিকভাবে যা চাওয়া হয় বাস্তবে তার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া যায়। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। অর্থাৎ কোনো ব্যবস্থাই শতভাগ নিশ্চিত বা অপচয়মুক্ত হতে পারে না। আবার আরেক ধরনের অপচয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যদি নকশায় কোনো ত্রুটি থাকে। তবে নকশায় সামান্য ত্রুটির কারণে অপচয়ে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের কারখানাগুলোর জ্বালানি ব্যবস্থাগুলোকে মোটামুটি টেকসই হিসেবে মত দিলেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক প্রকৌশলী রাজীব হায়দার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই এগুলোর নকশা করেন। বর্তমানে কারখানাগুলোয় স্টেট অব দি আর্ট প্রযুক্তির মেশিন ও বয়লার ব্যবহার করা হয়। যারা কোজেনারেশন, ট্রাইজেনারেশন ব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বাড়িয়ে নিয়েছেন, সেসব ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম। একটা গ্যাস লাইনে লিকেজ থাকতে পারে, তবে তা দক্ষতায় বড় প্রভাব ফেলতে পারে না বলেই আমি মনে করি।
কারখানার ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনের ত্রুটি ও অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন নিট পোশাক প্রস্তুতকারকরা। পাশাপাশি তারা এসব সমস্যা দূর করতে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোকবলের ঘাটতির কথাও উল্লেখ করেছেন। আবার লোকবল থাকলেও তাদের যথাযথ দক্ষতার ঘাটতি আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নিট পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, স্টিম যত দূরে যায় ততই চাপ কমে যায়। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, যেন স্টিম কাছাকাছি রাখা যায়। তবে অনেক সময় স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে দূরে বসাতে হয়। তবে সর্বোচ্চ প্রযুক্তির জ্বালানি ব্যবস্থা স্থাপনের সঙ্গে কোনো আপস করা হয় না বলেও দাবি তার। এটা ঠিক যে সবসময় দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। কারণ এগুলো ব্যবহার করার জন্য যে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোকবল প্রয়োজন, দেশে তার ঘাটতি রয়েছে।
কিছু কারখানায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনগুলোর ত্রুটি রয়েছে, এটা স্বীকার করে এ নেতা বলেন, স্বাভাবিকভাবেই এসব কারখানার জ্বালানি ব্যবস্থাপনাও দুর্বল। কিন্তু এখন যে কারখানাগুলো হচ্ছে, সেগুলো সব দিক পরিকল্পনা করেই হচ্ছে। প্রতিনিয়ত জ্বালানি ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা কমিয়ে আনা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ দুর্বলতার হার আরো কমিয়ে আনার বিষয়েও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
অন্যদিকে ওভেন পোশাক প্রস্তুতকারকরা বলছেন, জ্বালানি দক্ষতার সর্বোচ্চ উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু জ্বালানি সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন না হওয়ায় তা দক্ষভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণেই অপচয়ের ঘটনা ঘটছে।
পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি দক্ষতার সর্বোচ্চটা নিশ্চিতের চেষ্টা আমাদের সবসময়ই আছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে জ্বালানি দক্ষতা ভালো না হওয়ার কারণ গ্যাসের চাপ কম। জ্বালানি যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার আমরা দক্ষতার সঙ্গেই করছি।
অপচয়ের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসই তো পাওয়া যায় না, অপচয় হবে কীভাবে? তাই অপচয়ের প্রশ্নই ওঠে না। উল্টো গ্যাসের চাপ কম থাকায় অনেক সময় বয়লারের পানিই গরম হয় না। ফলে যথেষ্ট স্টিম পাওয়া যায় না।
খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে জ্বালানি দক্ষতার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। আর সে কারণেই শিল্প সম্প্রসারণ হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন গ্যাস সংযোগ তেমন বাড়েনি। গত কয়েক বছরে পোশাক উৎপাদন বেড়েছে, কারণ দক্ষতা বেড়েছে। অনেকে বয়লার পরিবর্তন করেছেন। যে গ্যাস দিয়ে আগে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হতো, সেই গ্যাস দিয়ে এখন দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। কোজেনারেশন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। জ্বালানি দক্ষতার উন্নয়ন হয়েছে, সময়ের সঙ্গে এ উন্নয়নের পরিমাণ বাড়ছে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়