দেশে জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেলের ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে পরিবহন, কৃষি ও শিল্প খাতে ডিজেলই প্রধান জ্বালানি। বড় মাত্রায় নির্ভরশীলতা রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতেরও। ডিজেল ও কেরোসিনের সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণায় এ চার খাতেই বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা এরই মধ্যে দৃশ্যমানও হয়ে উঠেছে।
দেশে প্রতি বছর জ্বালানি তেলের ব্যবহার হয় ৬০-৬৫ লাখ টন। এর মধ্যে ডিজেল ব্যবহার হয় ৪০-৪৫ লাখ টনের মতো। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় পর গত বৃহস্পতিবার দেশের বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য বাড়ানোর ঘোষণা দেয় জ্বালানি বিভাগ। নতুন ঘোষণা অনুযায়ী ডিজেল ও কেরোসিনের লিটারপ্রতি মূল্য ১৫ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকায়। গ্যাস সংকটের কারণে এরই মধ্যে মারাত্মক সংকটে ভুগছিল দেশের জ্বালানি খাত। ডিজেল ও কেরোসিনের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিতে এ সংকট আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কৃষি, পরিবহন, শিল্প ও বিদ্যুৎ—দেশের এ বড় চারটি খাত এরই মধ্যে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। সারা দেশেই এর কম-বেশি প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা আসার একদিন পার হওয়ার আগেই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে পরিবহন খাত। গতকাল সকালে আকস্মিকভাবে চলাচল বন্ধ করে দেয় দূরপাল্লার বাস, ট্রাকসহ অধিকাংশ যাত্রী ও পণ্য পরিবহন। পূর্ব ঘোষণা ছাড়া মালিকপক্ষ এভাবে পরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছে জনসাধারণ। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু যানবাহন চলাচল করলেও আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। ধর্মঘট থাকায় পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে খাদ্যপণ্য সরবরাহসহ সব ধরনের পণ্য পরিবহন সেবা ব্যাহত হচ্ছে। গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর দাবি তুলেছেন সড়ক পরিবহন মালিকরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি ও জাতীয় পার্টির নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে পরিবহন খাতে। তাই আমরা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর জন্য বিআরটিএতে আবেদন করেছি।
অন্যদিকে নৌপথে ভাড়া দ্বিগুণ করার আলটিমেটাম দিয়েছেন লঞ্চ মালিকরাও। সার্বিকভাবে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গোটা পরিবহন খাতেই এখন ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে গোটা অর্থনীতিতেই এর প্রভাব আসন্ন দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পরিবহন খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোটা ধাপে ধাপে করার সুযোগ ছিল। সেটা মানিয়ে নেয়ার সুযোগ ছিল। একেবারে লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ানো অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। পরিবহন ব্যয় বাড়লে নিত্যদিনের ব্যয়ও বেড়ে যাবে। পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম বাড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দিতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্যমতে, এ মূল্যবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে সেবা খাতগুলো অস্থির হয়ে উঠবে। বিশেষত যেসব খাতে এ ধরনের জ্বালানি পণ্যের ব্যবহার বেশি হয়, সেখানে জনসাধারণকে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হবে। পরিবহনের পাশাপাশি অন্য খাতগুলোতেও এর বড় প্রভাব পড়তে যাচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ডিজেল-কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি পরিবহন, কৃষি, বিদ্যুৎসহ সব জায়গায় প্রভাব ফেলবে। বিশেষত খরচ বাড়াবে। মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তা-উৎপাদক থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে দামটা বাড়ানো না হলে তা আবার সরকারের ভর্তুকির ওপরও চাপ সৃষ্টি করছে। তবে কেরোসিনের দামটা একটু চিন্তা করা যেত। যেহেতু কেরোসিন নিম্ন আয়ের মানুষ ব্যবহার করে, সেখানে সমন্বয় কিছুটা কম করার সুযোগ ছিল।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে দুটি বিষয় সরকার করতে পারে। প্রথমত, আমদানিতে বিপিসির যে মনোপলি রয়েছে, সেখানে বেসরকারি খাতকে আরো বেশি সুযোগ দেয়া হলে বাজারে কিছু প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হতো। তাতে দাম কিছুটা কমানো যেত। বিশেষত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা গেলে কম দামে তেল আমদানির সুযোগ থাকে। দ্বিতীয়ত, বিপিসির আমদানি তেলের ওপর শুল্ক থাকে। সেটি সমন্বয় করা হলে দামটা সহনীয় হতো, যেটি সম্প্রতি ভারত করেছে।
জ্বালানি-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সড়ক, রেল ও নৌযানে প্রতি বছর অন্তত সাড়ে ৩৫ লাখ টন জ্বালানি তেল ব্যবহূত হয়। এর মধ্যে ডিজেলের ব্যবহার হয় ২৫ লাখ ৭৪ হাজার টন। এসব পরিবহনে ব্যবহূত জ্বালানির ৭২ দশমিক ৭৯ শতাংশ ডিজেল।
তবে জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেলের ওপর নির্ভরশীলতা সবচেয়ে বেশি কৃষিতে। এ খাতে মোট ব্যবহূত জ্বালানি তেলের ৯৯ দশমিক ৭৩ শতাংশই ডিজেল। জ্বালানি তেলটির মূল্যবৃদ্ধি কৃষকদের সেচ ব্যয় আরো বাড়াবে। কৃষি খাতের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি খাতে কৃষকের লোকসান এমনিতেই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এর মধ্যে সেচ ব্যয় আরো বেড়ে গেলে উৎপাদন খরচই তুলতে পারবেন না কৃষকরা।
দেশে কৃষি খাতে ব্যবহূত ডিজেলচালিত সেচযন্ত্রের সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। গভীর-অগভীর নলকূপ, এলএলপি, পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টরের জ্বালানি হিসেবে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ডিজেলের ব্যবহার হয়। বিপিসির ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষিতে ব্যবহূত যন্ত্রে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১৯ লাখ ৩৯ হাজার টন। কৃষিকাজে ব্যবহূত যন্ত্রে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন পর্যায়েও খরচ বাড়বে। তবে বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাশা, ফসল উৎপাদনে সেচ ব্যয়ের চাপকে বিবেচনায় নিয়ে সরকার ডিজেলে কিছুটা ভর্তুকি বাড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে কৃষকের ওপর চাপ কমবে।
শিল্প খাতের উৎপাদন ব্যয়ও সরাসরি প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি। শিল্প খাতে ডিজেলের প্রধান ব্যবহার মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী জেনারেটরের জ্বালানি হিসেবে। কভিডের আগেও শিল্প খাতে জ্বালানি তেলের বার্ষিক ব্যবহার ছিল ৪ লাখ ২১ হাজার টন। এর মধ্যে ডিজেল ছিল ৩ লাখ ৪১ হাজার টন। অর্থাৎ শিল্প খাতে মোট ব্যবহূত জ্বালানি তেলের ৮০ দশমিক ৯৮ শতাংশই ডিজেল।
খাতটির উদ্যোক্তারা বলছেন, ডিজেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে কলকারখানায় উৎপাদনে ব্যয় এমনিতেই বেড়ে যায়। সে হিসেবে জ্বালানি তেলটির মূল্যবৃদ্ধি এ খাতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়ারই কথা। আমরা যারা ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালাই, তাদের উৎপাদন খরচ বাড়বে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়