উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি কৃষি ও খাদ্য অর্থনীতিকে চাপে ফেলবে

আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম এখন কমছে। বর্তমানে তা কভিডপূর্ব পর্যায়ের কাছাকাছি। যদিও গত এক বছরে দেশে সারের দাম বেড়েছে অন্তত দুই দফায়। একই সঙ্গে কয়েক দফায় বেড়েছে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম। সামনের দিনগুলোয় তা আরো বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে। দেশের বাজারে সার এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি কৃষি ও খাদ্যপণ্যের সরবরাহ চেইনে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। সেক্ষেত্রে গোটা অর্থনীতিতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদরাও আশঙ্কা করছেন।

গত বছরের আগস্টে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ৬ টাকা বাড়ানো হয়। এরপর গত এপ্রিলে ইউরিয়াসহ অন্যান্য রাসায়নিক সারের দাম আরেক দফায় বাড়ানো হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্টে ইউরিয়ার সারের দাম কৃষক পর্যায়ে ৬ টাকা বাড়িয়ে ১৬ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর চলতি বছরের এপ্রিলে আরেক দফায় বাড়ানো হয়। এ সময় ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি—এ চার ধরনের সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। এতে কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া ২৭ টাকা, ডিএপি ২১, টিএসপি ২৭ ও এমওপি ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ সময় সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম চড়া থাকার কথা জানানো হয়। 

যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে রাসায়নিক সারের দাম চলতি বছরের শুরু থেকেই টানা কমতির দিকে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পিংক শিটের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কিছুটা অস্থিতিশীল সময় পার করলেও এখন তা টানা কমতে শুরু করেছে। বাজারে সারের দাম এখন প্রাক-কভিডকালের কাছাকাছি পর্যায়ে। কভিডকালীন অভিঘাত ২০২১ সালে ডিএপি সারের দাম প্রতি টন ৬০১ ডলারে উঠে গিয়েছিল। গত বছর তা ৭৭২ ডলার ২০ সেন্টে উঠে যায়। সর্বশেষ চলতি ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষের মে মাসে তা বিক্রি হয়েছে ৫১০ ডলারে। একইভাবে পটাশিয়াম ক্লোরাইড বা মিউরেট অব পটাশের (এমওপি) দাম ২০২১ সালের ৫৪২ ডলার ৮০ সেন্ট থেকে গত মাসে ৩৭২ ডলার ৫০ সেন্টে বিক্রি হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে টিএসপি সারের দাম ৫৩৮ ডলার ২০ সেন্ট থেকে ৪৮৫ ডলার ৬০ সেন্টে এবং ইউরিয়া সারের দাম ৪৮৩ ডলার ২০ সেন্ট থেকে ৩২৯ ডলার ৩০ সেন্টে নেমে এসেছে। 

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাসায়নিক সারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে দেশের কৃষি খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে তা খাদ্যের উৎপাদন এবং বাজার পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। ব্যাহত হবে খাদ্য নিরাপত্তা। একই সঙ্গে তা খাদ্যসহ সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে।

সারের মূল্যবৃদ্ধি করে এপ্রিলে দেয়া ঘোষণার পর এপ্রিলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) এক বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সারের মূল্যবৃদ্ধি সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয় গত বছরের আগস্টের শুরুতে। ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে তখন প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ১১৪ টাকা করা হয়। অকটেন প্রতি লিটার ৮৯ থেকে ১৩৫ টাকা, পেট্রল ৮৬ থেকে ১৩০ এবং কেরোসিন ৮০ থেকে ১১৪ টাকা করা হয়। যদিও আগস্টের শেষে প্রত্যেকটির দাম লিটারে মাত্র ৫ টাকা কমানো হয়। চলতি বছরের শুরু থেকে বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ করে তিন দফায় মোট ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

সামনের দিনগুলোয়ও সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য আরো বাড়ানোর জোর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। সেক্ষেত্রে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনসহ সার্বিক সরবরাহ চেইন আরো অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার জোর আশঙ্কা করছেন তারা।

এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পণ্যের মূল্য কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন খাতে সেচ এবং বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যয়কে আরো বাড়িয়ে তুলবে। একই সঙ্গে খাদ্য শিল্পের কারখানাগুলোরও ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মানতে গিয়ে সার, জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। সামনে আরো বাড়ানো হবে। এর স্বল্পমেয়াদি প্রভাবে কৃষি খাতে উৎপাদন ব্যাহত ও বাজার অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতির বেশকিছু সূচকের ব্যাপক অবনমনের আশঙ্কা রয়েছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে খাদ্য ও কৃষিপণ্যের ভ্যালু চেইন ও কর্মসংস্থানেও। 

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. আবদুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইএমএফ সবসময়ই ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে চাপ দিয়েছে।এখন যেহেতু আইএমএফের ঋণ নেয়া হয়েছে, সেহেতু তার শর্ত মানতে হলে ভর্তুকি কমাতে হবে। সামনে হয়তো আরো অনেক ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমাতে হবে। কৃষি উৎপাদনে সারের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। আর এ সারের দাম গত কয়েক মাসে দুই দফায় বেড়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এতে কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। সরবরাহেও খরচ বেড়ে যাবে। পুরো খাদ্য ব্যবস্থাপনার মূল্য অনেক বেড়ে যাবে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন যারা অতি গরিব তাদের খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি হবে। সরকার সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম চালালেও সেখানে সুবিধাভোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। এতে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। ভর্তুকি কমানোর ফলে কর্মসংস্থানেও প্রভাব পড়বে। এরই মধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে। আবার মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এভাবে চললে সামনে আরো বাড়বে। আমাদের এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মূল্যস্ফীতি এবং স্থানীয় মুদ্রার মান কমে যাওয়া।’

দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় অর্ধেক মানুষ কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) এবং সিজিআইএআর প্রকাশিত ‘মেজারিং চেঞ্জেস ইন বাংলাদেশ’স এগ্রি-ফুড সিস্টেম’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে মোট কর্মসংস্থান ছিল ৬ কোটি ৪৭ লাখ। এর মধ্যে শুধু কৃষিতে কর্মসংস্থান ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ, যা মোট কর্মসংস্থানের ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থা মিলিয়ে মোট কর্মসংস্থান ছিল ৩ কোটি ২৩ লাখ। অর্থাৎ দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৫০ শতাংশ মানুষই কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। 

২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের মোট জিডিপির আকার হিসাব করা হয়েছে ৪৬০ দশমিক ২ বিলিয়ন (৪৬ হাজার ২০ কোটি) ডলার। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট জিডিপিতে কৃষি ও খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থার অবদান ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। সে অনুযায়ী, দেশের কৃষি ও খাদ্য জিডিপির আকার দাঁড়ায় প্রায় ১১ হাজার ৪১৩ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক আবার শুধু কৃষি উৎপাদন। দেশের মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। আইএফপিআরআইয়ের তথ্য ও ২০২১-২২ অর্থবছরের জিডিপির আকারের ভিত্তিতে হিসাব করে দেখা গেছে কৃষি জিডিপির আকার ৫ হাজার ৬৬০ কোটি ডলারের বেশি। 

বিদ্যুৎ-জ্বালানি এবং সারের মূল্যবৃদ্ধি কৃষক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত সবার জন্য বড় বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এমনকি তা চাপে থাকা রিজার্ভকে আরো চাপে ফেলার জোর আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছেন তারা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি বা সারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বাড়তি এ খরচ চূড়ান্তভাবে ভোক্তার ওপর এসে পড়বে। আমাদের বাড়তি দামেই কিনে খেতে হবে। আবার উচ্চমূল্যের কারণে কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি বেড়ে যাওয়ার একটা ঝুঁকি তৈরি হবে।’

কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের অবদান ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া সার্বিক কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার উপকরণ ও কাঁচামাল সরবরাহ, বাণিজ্য ও পরিবহন এবং হোটেল ও খাদ্যসেবা খাত অবদান রাখছে যথাক্রমে ২ দশমিক ২ শতাংশ, ৫ দশমিক ৬ এবং ১ শতাংশ। এ অনুযায়ী হিসাব করলে দেখা যায়, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের আকার ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বেশি। উপকরণ ও কাঁচামাল সরবরাহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের মোট আর্থিক আকার ১ হাজার ১২ কোটি ডলার। কৃষি এবং খাদ্যশিল্পের বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবসার আকার ২ হাজার ৫৭৭ কোটি ডলার। এর সঙ্গে হোটেল ও খাদ্যসংশ্লিষ্ট সেবা কার্যক্রমের আয়তন দাঁড়ায় ৪৬০ কোটি ডলারের বেশি। 

প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, দেশের কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার মোট সরবরাহ চেইনের খাদ্যশস্যের অবদান ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া ডালশস্য ও তেলবীজ ৩ দশমিক ২০ শতাংশ, শেকড় ও কন্দজাতীয় ফসল ২ দশমিক ৩০, হর্টিকালচার ৫ দশমিক ৬, পশুখাদ্য ১৮ দশমিক ২০, মৎস্যখাদ্য ১৬ দশমিক ২০, রফতানিমুখী খাদ্য ৪ দশমিক ৭০, রফতানিমুখী খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ৬ দশমিক ৬০, বনজ সম্পদ ১৪ দশমিক ৪০ এবং পানীয় ও অন্যান্য ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ অবদান রাখছে। 
এই বিভাগের আরও খবর
বোতলের সয়াবিন তেলের লিটার ১৬৭, খোলা ১৪৭ টাকা

বোতলের সয়াবিন তেলের লিটার ১৬৭, খোলা ১৪৭ টাকা

দৈনিক ইত্তেফাক
মেট্রোরেলের টিকিটে ভ্যাট না বসানোর চেষ্টা চলছে

মেট্রোরেলের টিকিটে ভ্যাট না বসানোর চেষ্টা চলছে

প্রথমআলো
বাংলাদেশ থেকে সরাসরি তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারে ব্রাজিল

বাংলাদেশ থেকে সরাসরি তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারে ব্রাজিল

বিডি প্রতিদিন
ভারতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের রেকর্ড

ভারতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের রেকর্ড

বিডি প্রতিদিন
বাংলাদেশে গত এক যুগে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে মধ্যপ্রাচ্যের অবদান সামান্য

বাংলাদেশে গত এক যুগে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে মধ্যপ্রাচ্যের অবদান সামান্য

বণিক বার্তা
ঈদের আগে দুই দফা বাড়তে পারে সয়াবিন তেলের দাম

ঈদের আগে দুই দফা বাড়তে পারে সয়াবিন তেলের দাম

জনকণ্ঠ
ট্রেন্ডিং
  • ভালোবাসা দিবসে পরী মনির ‘বুকিং’

  • নির্বাচনের আগে পাকিস্তানে জোড়া বিস্ফোরণে নিহত ২৮

  • ভিসা পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে নিলো যে দেশ

  • শন্তিপূর্ণভাবে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি: প্রধানমন্ত্রী

  • ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের পারমাণবিক অস্ত্র বাড়বে তিন গুণ

  • তানজানিয়ায় প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৯

  • ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার বেশি থাকলে বেশি কর

  • কাতার বিশ্বকাপে ফিরছে জিদানের সেই ভাস্কর্য

  • ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞায় তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া

  • অবিশ্বাস্য কীর্তিতে হাজার রানের ক্লাবে এনামুল বিজয়