মালদ্বীপ ও নেপালের স্থানীয় রাজনীতিতে এখন বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে দেশগুলোর জনসাধারণের ভারতবিরোধী মনোভাব। শ্রীলংকায়ও ভারত নিয়ে স্থানীয়দের ধারণা খুব একটা ইতিবাচক নয়। এ মনোভাব কিছু মাত্রায় উপস্থিত বাংলাদেশেও। বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ভারতীয় বিশ্লেষকদের। তারা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে গত কয়েক বছরে চীনের প্রভাব অনেকটাই বেড়েছে। একই সঙ্গে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে ভারতের। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এসব দেশের স্থানীয় জনগণের মধ্যেও ভারতবিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবই মূল নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে।
দিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) এক সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে অভিযোগ করে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে ভারত নিয়ে নেতিবাচক ধারণা প্রবল হয়ে ওঠার পেছনে চীনের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। বিষয়টি এখন এ অঞ্চলের স্থানীয় রাজনীতিতেও বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে। মালদ্বীপের আব্দুল্লা ইয়ামিন ও নেপালের কেপি শর্মা ওলির নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা, বক্তব্য, নীতি ও ভোটের বড় ভিত্তি হলো ভারতবিরোধিতা। এক্ষেত্রে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতাও বড় ভূমিকা রেখেছে। ইয়ামিন ও ওলি দুজনের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির মাধ্যমে চীনা প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকে সুবিধা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আঞ্চলিক নিট নিরাপত্তাদাতা দেশ হিসেবে ভারতের ভূমিকাকে সমস্যাসংকুল করতে চীন মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনকে কাজে লাগিয়েছে। ২০১৭ সালে দোকলামে উত্তেজনা শুরু হওয়ার পর ইয়ামিন তার ভারতবিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি মালদ্বীপে ভারতীয় টহলযান, উড়োজাহাজ ও কর্মীদের কাজে লাগানোর বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়েছেন। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে শুরু হওয়া ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলন গতি পাওয়ার পেছনেও বিষয়টি কাজ করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের জনসাধারণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাবের বিষয়টি অনেকটা ঐতিহাসিকভাবেই বিদ্যমান বলে মনে করছেন ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের নানা ইস্যুতে বিরোধ রয়েছে। দেশটির স্বাধীনতার পর থেকেই তীব্র বৈরিতা রয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে। অন্যান্য দেশের সঙ্গেও ভারতের অনেক ইস্যু এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। অনিষ্পন্ন এসব ইস্যু দেশগুলোর জনসাধারণের মধ্যে ভারত নিয়ে এক ধরনের অবিশ্বাস ও বৈরী মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বড় প্রভাবক হয়ে উঠেছে ইস্যুগুলো। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীন দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আরো বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু ভুটান ও আফগানিস্তান। চীনের সঙ্গে বিরোধ ভুটানকে ভারতের কাছে নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যে (তালেবানদের কাবুল দখলের আগ পর্যন্ত) ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেছিল আফগানদের পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বাস।
এ বিষয়ে ওআরএফের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এ অঞ্চলের জনগণের ভারতবিরোধী মনোভাবের ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। দাক্ষিণাত্যের চোল সম্রাটরা শ্রীলংকা ও মালদ্বীপে অভিযান চালিয়েছিলেন একাদশ ও দ্বাদশ শতকে। দেশ দুটির জনগণ এখনো ওই সময়ের ইতিহাসকে স্মরণ করে। হিন্দু জমিদারদের স্মৃতি এবং ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও সাতচল্লিশের দেশভাগ বাংলাদেশীদের মধ্যে ভারত নিয়ে এক ধরনের সন্দিহান মনোভাব তৈরি করে রেখেছে। ঔপনিবেশিকতার বাইরে থেকে যাওয়া নেপালে একই ধরনের সন্দেহ তৈরি করে রেখেছে লুম্বিনির ওপর অধিকার নিয়ে বিরোধ। এছাড়া এ সন্দিহান মনোবৃত্তির পেছনে ধর্মীয় পরিচয়েরও বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। শ্রীলংকায় এ সন্দেহকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে তামিলদের নিয়ে দুই দেশের নীতি। এছাড়া এ অঞ্চলের দেশগুলোর জাতিগত বিরোধসহ অভ্যন্তরীণ নানা ইস্যুতে ভারতের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও মন্তব্য স্থানীয়দের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের মাত্রা আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
অনেকটা ঐতিহ্যগতভাবেই প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিজ নিরাপত্তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে এসেছে ভারত। ওআরএফের বিশেষজ্ঞ গবেষক আদিত্য গোদারা শিবমূর্তির ভাষ্যমতে, নয়াদিল্লি দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরকে বরাবরই নিজের প্রভাব বলয় ও প্রথম প্রতিরক্ষা লাইন হিসেবে বিবেচনা করেছে। এ ধ্যানধারণা থেকে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে নিজস্ব অবস্থান ধরে রাখতে গিয়ে অন্যদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, চুক্তি এবং অর্থনৈতিক অবরোধের মতো নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বিষয়টি ভারতকে পাকিস্তান ও চীনের হুমকি থেকে অনেকটা নিরাপদ রেখেছে। কিন্তু এতে করে অন্যান্য দেশের জনসাধারণের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে, ভারত তুলনামূলক ছোট আয়তনের দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের নির্দেশনামূলক ভূমিকা রাখছে। কিন্তু চীনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) মতো প্রকল্পগুলো থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশা তৈরি করেছে। ভারত নিজ অবস্থান থেকে এসব প্রকল্পের বিরোধিতা করার পাশাপাশি দেশটির সংবেদনশীলতা ও নিরাপত্তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য প্রতিবেশীদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে। এ বিষয়টিই দেশগুলোর বিভিন্ন অংশে এমন এক চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছে, যার মূল কথা হলো দেশটি সুযোগ-সুবিধা দেয় অনেক কম, কিন্তু হস্তক্ষেপ করে বেশি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আদিত্য গোদারা শিবমূর্তি ই-মেইলের মাধ্যমে বণিক বার্তাকে বলেন, ভারত নিয়ে জনসাধারণের নেতিবাচক ধারণার ফলে বিষয়টিকে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে আরো কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিষয়টি এসব দেশে ভারতের বিনিয়োগ ও সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসার পথে ব্যাঘাত ঘটাবে। এছাড়া নিজ নিজ রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী বক্তব্যগুলোর ন্যায্যতা তুলে ধরতে কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা চীনের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর প্রয়াসও নিতে পারেন।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়