মুদ্রা বিনিময়ের (কারেন্সি সোয়াপ) ভিত্তিতে বাংলাদেশের কাছ থেকে ২০ কোটি ডলার সংগ্রহ করছে শ্রীলংকা। দু-একদিনের মধ্যেই এ বিনিময় কার্যক্রম শুরু হচ্ছে বলে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর গতকাল জানিয়েছেন। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে শ্রীলংকাকে ডলার সরবরাহে বাংলাদেশকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে চীন।
বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে মরিয়া কলম্বো এ নিয়ে আরো কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে চীনের ওপরই শ্রীলংকাকে নির্ভর করতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। দেশটির কাছ থেকে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে ১৫০ কোটি ডলার সংগ্রহে চুক্তি করেছে কলম্বো।
শুধু বৈদেশিক মুদ্রা নয়, লংকাদ্বীপের অর্থনীতির সব খাতেই এখন চীনের ওপর নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। সর্বশেষ চলতি সপ্তাহেও কভিড মোকাবেলা ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য চীনের সঙ্গে প্রায় ৩১ কোটি ডলারের একটি ঋণ চুক্তি সই করেছে কলম্বো সরকার।
রাজাপাকসে পরিবারের শাসনামলে শ্রীলংকায় ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে চীন। বেইজিং এখন লংকাদ্বীপের অবকাঠামো খাতের অধিকাংশ মেগা প্রজেক্টেরই প্রধান বিনিয়োগকারী। এসব প্রকল্পের মধ্যে যেমন নৌবন্দর, বিমানবন্দর ও সড়ক অবকাঠামো রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিশেষায়িত নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলও।
শ্রীলংকার মতো পাকিস্তানও এখন চীনের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। এ অঞ্চলে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের সবচেয়ে বড় অংশীদার ধরা হয় পাকিস্তানকে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, কানেক্টিভিটি, সড়ক ও রেল যোগাযোগ অবকাঠামোসহ পাকিস্তানের অর্থনীতির সব খাতেই জোর উপস্থিতি রয়েছে বেইজিংয়ের। সম্প্রতি চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি) আওতায় করাচি থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ প্রকল্পও বাস্তবায়ন হচ্ছে চীনের অর্থায়নে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও এখন অবকাঠামো খাতে চীনের অবস্থান আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরালো হয়ে উঠেছে। ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মতে, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এখন চীনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলের ভূরাজনীতির গোটা কাঠামোকেই পুরোমাত্রায় পাল্টে দিয়েছে বেইজিং। কিছুদিন আগেও এ অঞ্চলে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ ধরা হতো ভারতকে। সে জায়গা এখন চীনের দখলে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট বেঁধে আঞ্চলিক ভূরাজনীতির ভরবিন্দুর এ আমূল পরিবর্তন মোকাবেলায় বেশ জোর প্রয়াস চালিয়েছে নয়াদিল্লি। সক্রিয় করে তোলা হয়েছে প্রায় বিস্মৃত কোয়াড জোটকে। যদিও সে প্রয়াসও খুব একটা কাজে দেয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশই এ জোটে যোগ দেয়নি।
টিকাকে হাতিয়ার করে কভিডকালীন ভূরাজনীতিতে চীনকে টেক্কা দেয়ার জোর প্রয়াস চালিয়েছিল ভারত। চলতি বছরের শুরুর দিকেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো টিকার জন্য নয়াদিল্লির ওপরেই নির্ভর করেছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু মহামারী প্রকট আকার নিলে টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপে বাধ্য হয় নয়াদিল্লি। একই সময়ে গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই কভিডের নতুন সংক্রমণপ্রবাহ ভয়াবহ রূপ নেয়। বিপাকে পড়ে যায় এ অঞ্চলে টিকার জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া দেশগুলো। ঠিক সেই মুহূর্তে শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসে চীন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে এখন টিকাদান কর্মসূচির প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে চীনের সরবরাহকৃত ভ্যাকসিন।
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক নতুন দুটি আঞ্চলিক জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে চীন। এপ্রিলের শেষ দিকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঞ্চালনায় দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে একটি ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভূরাজনীতি-বিষয়ক আন্তর্জাতিক মাধ্যম ফরেন পলিসি জানাচ্ছে, ওই বৈঠকের আলোচনার ফল হিসেবেই জোট দুটির গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ওই বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। পরে গত মাসের শুরুর দিকে চীনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চেংদুতে এসব দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন। চায়না-সাউথ এশিয়া ইমার্জেন্সি সাপ্লাইস রিজার্ভ ও চায়না-সাউথ এশিয়ান কান্ট্রিজ পভার্টি অ্যালিভিয়েশন অ্যান্ড কোঅপারেটিভ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার নামে নতুন জোট দুটিকে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ দাবি করছেন সার্ক ও বিমসটেকের জোটের বিকল্প হিসেবে। এ উদ্যোগ সফল হলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব আরো খর্ব হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের ভূমিকা অনেকটা নীরব পর্যবেক্ষকের। দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হলে দেশটির আন্তর্জাতিক কূটনীতির চাণক্যদের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এ অঞ্চলের কূটনৈতিক সম্পর্কগুলোর মৌলিক বিষয়বস্তুতে এখন আমূল পরিবর্তন এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও এখন নিজ নিজ চিরাচরিত ভূমিকা থেকে বেরিয়ে আসছে। এ পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক চীন। নানা খাতে এখানকার দেশগুলোর সঙ্গে বেইজিংয়ের অংশীদারিত্বের সম্পর্ক দিন দিন দৃঢ় হচ্ছে। ঠিক এর বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে ভারতের ক্ষেত্রে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, ক্রমাগত বিরোধিতা করে গেলেও এ অঞ্চলের দেশগুলোর সামনে বিআরআইসহ বেইজিংয়ের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাগুলোর ভালো কোনো বিকল্প তুলে ধরতে পারেনি নয়াদিল্লি। এমনকি এ অঞ্চলের দেশগুলোর সম্পর্কেও নতুন কোনো মাত্রা যুক্ত করতে পারেনি ভারত। চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বিরোধের সুবাদে পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন হলেও ভারত এখন আঞ্চলিক পর্যায়ে অনেকটাই একা হয়ে পড়ছে।
চলমান আফগান সংকটে বিষয়টি আরো প্রকট হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার-পরবর্তী আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ আয়োজিত আলোচনাগুলোয় এক প্রকার অনুপস্থিত ছিল ভারত। যদিও ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাও অনেকটাই নির্ভর করছে আফগানিস্তানের পরিস্থিতির ওপর। অন্যদিকে তালেবানদের কাবুল দখলের আগ থেকেই কূটনৈতিকভাবে বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বাড়িয়েছে চীন। বেইজিংয়ের জন্য নিরাপত্তা হুমকি তৈরিতে কাউকে আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেয়া হবে না বলে তালেবানদের কাছ থেকে নিশ্চয়তাও নিয়েছে। বর্তমানে চীন আফগানিস্তানের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এজন্য তালেবানদের সরকার গঠন প্রক্রিয়া শেষ হলে বেইজিং দ্রুত স্বীকৃতি দিয়ে দিতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের ভাষ্যমতে, সেক্ষেত্রে আফগানিস্তানও দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাববলয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়