জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় স্থানীয় পর্যায়ে কয়লা উত্তোলন বাড়াচ্ছে চীন ও ভারত। পণ্যটির শীর্ষ দুই ব্যবহারকারী দেশ এ মুহূর্তে চাহিদা পূরণের জন্য স্থানীয় সরবরাহের ওপরই নির্ভর করছে বেশি। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দর এ মুহূর্তে কিছুটা পড়তির দিকে। যদিও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও অন্যান্য জ্বালানি পণ্যের দাম এখনো বেড়েই চলেছে। বাজার সংশোধনের প্রবণতায় এলএনজির দাম গত কয়েকদিনে কিছুটা কমলেও তা যেকোনো মুহূর্তে আবারো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রেও অন্যতম প্রধান প্রভাবক এখন চীন।
শীত সামনে রেখে দেশটি এখন উচ্চমূল্যেই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে যাচ্ছে। দেশটির গত মাসের বাণিজ্য পরিসংখ্যানেও দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিটি জ্বালানি পণ্যেরই আমদানি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়েছে চীন। কিছুদিন আগে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেকোনো মূল্যে শীতকালের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান করে রাখতে হবে। তার সে নির্দেশনা পালিত হয়েছে অক্ষরে অক্ষরে।
চীনের এ ক্রমবর্ধমান আমদানি ও জ্বালানি পণ্যের ঊর্ধ্বমুখিতা ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে। শীত ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গোটা ইউরোপেই জ্বালানি সংকটের আশঙ্কা তীব্রতর হয়ে উঠেছে। বছরের এ সময় মহাদেশটিতে বরাবরই জ্বালানি পণ্যের চাহিদা থাকে সর্বোচ্চে। যদিও ঠিক এ সময়েই ইউরোপে জ্বালানির সরবরাহ নিয়ে সবচেয়ে বড় সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্যাপক চাপে পড়ে গিয়েছে মহাদেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ শিল্প ও ভোক্তা খাত।
এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় জ্বালানির সংস্থান নিয়ে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো এখন রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠেছে। বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জ্বালানির মজুদ নিয়ে চীনের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় নামা ছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলোর সামনে এ মুহূর্তে আর কোনো পথ খোলা নেই।
অথচ কিছুদিন আগেও জ্বালানি নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি বিব্রতকর অবস্থা পার করেছে চীন। জ্বালানি পণ্যের মারাত্মক সংকট দেশটির অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধারের যাবতীয় প্রয়াসকে বিপন্ন করে তুলেছিল। গত মাসেও অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতি পার করতে হয়েছে দেশটিকে। ওই সময়ে শিল্প ও আবাসিক খাতের ভোক্তাদের বিদ্যুতের সরবরাহ দিতে হয়েছে রেশনিংয়ের মাধ্যমে। বিঘ্নিত হয়েছে পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ও মোবাইল ফোন সেবা। এমনকি মাঝেমধ্যে রাস্তায় ট্রাফিক লাইট ও সড়কবাতিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোনো কোনো স্থানে ভোক্তাদের মধ্যে প্যানিক বায়িংয়ের (আতঙ্কিত হয়ে ক্রয়প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়া) খবরও মিলছে। সরকারও নাগরিকদের মোমবাতিসহ শীতের প্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ গড়ে তোলার উপদেশ দিয়েছিল।
বর্তমানে সে সংকট অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে চীন। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান স্টেট গ্রিড করপোরেশন অব চায়না (স্টেট গ্রিড) জানিয়েছে, কয়লার উত্তোলন বৃদ্ধি ও বৃহৎ ব্যবহারকারীদের চাহিদায় লাগাম টানার মাধ্যমে দেশটির ব্ল্যাকআউট পরিস্থিতিতে এখন কিছুটা লাগাম টানা গিয়েছে। যদিও শীতকালে এ পরিস্থিতি পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব হবে কিনা, সে বিষয়ে এখনই স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।
স্টেট গ্রিডের এ বক্তব্যের রেশ ধরে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, গত মাসে চীনকে যে আগ্রাসী গতিতে জ্বালানি সংগ্রহ করতে দেখা গিয়েছে, তা আরো বেশ কিছুদিন বজায় থাকবে। সেক্ষেত্রে শীত পেরিয়ে বসন্ত আসার আগে পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের সম্ভাবনা খুব কম। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে জ্বালানি পণ্য সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় জোরেশোরে নামা ছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলোর আর কোনো গতি নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি প্রতিযোগিতার দিকে মোড় নিলে স্বাভাবিকভাবেই জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়বে আরো দ্রুতগতিতে। অন্যদিকে এ প্রতিযোগিতা দীর্ঘায়িত হয়ে উঠলে, তা সার্বিকভাবেই গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য অমঙ্গলজনক হয়ে দেখা দেবে।
বিশেষ করে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজার এ মুহূর্তে বেশ ভালোই অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নিউইয়র্ক মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জে (নিমেক্স) গতকাল মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম বেড়েছে ১ দশমিক ১ শতাংশ। ডিসেম্বরে সরবরাহের চুক্তিতে গতকাল এখানে প্রতি ব্যারেলে ডব্লিউটিআই বিক্রি হয়েছে ৮২ ডলার ১৮ সেন্টে। অন্যদিকে গতকাল একদিনে আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দাম বেড়েছে ১ শতাংশ। ইউরোপের আইসিই ফিউচার্স এক্সচেঞ্জে গতকাল ব্রেন্টের মূল্য স্থির হয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৮৩ ডলার ৫৪ সেন্টে।
এশিয়ার দেশগুলোয় সরবরাহের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বাজার আদর্শ অ্যারাব লাইট ক্রুডের দাম বাড়িয়েছে সৌদি অ্যারামকোও। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে বিভিন্ন দেশে সরবরাহের জন্য জ্বালানি তেলের দাম প্ল্যাটস দুবাই ও ডিএমই ওমানের গড় মূল্যের চেয়ে ব্যারেলপ্রতি ২ ডলার ৭০ সেন্ট অতিরিক্ত করে রাখা হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
মার্কিন আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান ব্যাংক অব আমেরিকার পূর্বাভাস বলছে, বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৪৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়াবে ১২০ ডলারে।
অন্যদিকে এলএনজির দাম এ মুহূর্তে কিছুটা পড়তির দিকে থাকলেও অচিরেই তা আবার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার জোর আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলোর জ্বালানি সংগ্রহের প্রতিযোগিতা এ পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলতে পারে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠা ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য অনেকটাই কঠিন হবে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, চীনের জ্বালানি পণ্য সংগ্রহকারী রাষ্ট্রায়ত্ত তিন প্রতিষ্ঠান পেট্রোচায়না, সিনোপেক ও সিএনওওসির আর্থিক সক্ষমতা ইউরোপের জ্বালানি সরবরাহকারী যেকোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক বেশি।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যমতে, কিছুটা অসম হলেও ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষেও এ প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলা খুব একটা সম্ভবপর হবে না। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের জন্য পরিস্থিতি এখন অনেক কঠিন হয়ে উঠেছে। গ্রাহক পর্যায়ে জ্বালানির সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেয়ার কারণে দেশটির জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা অনেক সীমিত। এরই মধ্যে দেশটির বেশ কয়েকটি ছোট ও মাঝারি ধরনের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। গ্যাসের দাম আরো বাড়তে থাকলে আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি নিয়েই জ্বালানি সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নামতে হতে পারে যুক্তরাজ্যকে।
একই পরিস্থিতি ফ্রান্সেও। দেশটির জ্বালানি খাতের সরবরাহকারী সব প্রতিষ্ঠানই এখন মারাত্মক সংকটের মধ্যে রয়েছে। যদিও দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ঠিক এখনই গৃহস্থালি ও শিল্প খাতে জ্বালানির সরবরাহ মূল্য বাড়াতে চাইছেন না। দেশটিতে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় আর ছয় মাসও বাকি নেই। এ কারণে ঠিক এখনই ভোটারদের চটাতে খুব একটা আগ্রহী নন তিনি।
সার্বিকভাবে গ্যাসসহ জ্বালানি পণ্যের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি ইউরোপের দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বড় ধরনের চাপ ফেলতে যাচ্ছে। বর্তমানে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের ফিউচার মার্কেটে গ্যাসের মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে রেকর্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এরই মধ্যে জ্বালানি পণ্যটির মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ছয় গুণেরও বেশিতে। এর বিপরীতে ইউরোপের উত্তর-পশ্চিম অংশে এখন এলএনজির আমদানি অনেকটাই কমে গিয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এশিয়ার দেশগুলো এখন উচ্চমূল্যে ও বাড়তি পরিমাণে জ্বালানি আমদানি করছে। বিশেষ করে এলএনজির ক্ষেত্রে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের মতো দেশগুলোর মধ্যে এখন এ প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। দেশগুলোর মজুদ সক্ষমতাও ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। রাষ্ট্রীয় সহায়তার জোরে মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই দ্রুত এলএনজি সংগ্রহ করছে এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো। অন্যদিকে ইউরোপের দেশগুলো ভুগছে গ্যাস সংকটে। শীতকাল শুরুর আগে মহাদেশটিতে গ্যাসের এমন সরবরাহ সংকট আর কখনই দেখা যায়নি।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়