মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের বৈরি দুটি দেশ ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে অনেক দিন ধরে চলা অঘোষিত ছায়াযুদ্ধ এখন উদ্বেগজনকভাবে তীব্র হয়ে উঠেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ইরানের নাতাঞ্জে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়াম পরিশোধনাগারে এই সপ্তাহান্তে যে রহস্যজনক বিস্ফোরণ হয়েছে, দেশটি তার জন্য দায়ী করেছে ইসরায়েলকে।
ইরান এটাকে ‘নাশকতামূলক কাজ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। যদিও ইসরায়েল এই ঘটনার পেছনে তাদের হাত রয়েছে বলে প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যমে কিছু কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, যারা বলেছেন ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়েছে।
ইরান বলেছে, তারা ‘তাদের বেছে নেওয়া যে কোনও সময়ে’ অবশ্যই এর প্রতিশোধ নেবে। এটা কিন্তু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দুই দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বৈরি ও প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের মাত্রা ক্রমশই বাড়িয়ে তুলেছে। পুরো যুদ্ধ বাধলে তা দুই দেশের জন্য ব্যাপক বিধ্বংসী হবে বলে সেটা এড়িয়ে তলে তলে তাদের ঠাণ্ডা লড়াই আরও তীব্র করে তুলেছে। এতে বিপদের ঝুঁকিগুলো কোথায় আর এর পরিণতিই বা কী হতে পারে? এই ছায়াযুদ্ধের ক্ষেত্র মূলত তিনটি।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি
ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ বেসামরিক কাজে ব্যবহার করা হবে বলে বারবার আশ্বাস দিলেও ইসরায়েল তা বিশ্বাস করে না। ইসরায়েল নিশ্চিত যে, ইরান গোপনে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করছে যা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য হবে।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের ইসরায়েল সফরের সময় সোমবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘ইরানের কট্টরপন্থী প্রশাসন যে হুমকি সৃষ্টি করছে, মধ্যপ্রাচ্যের জন্য তা সবচেয়ে ভয়ানক, সবেচয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হুমকি।’
লন্ডনে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যিপি হতোভেলি। সোমবার বিবিসি-কে তিনি বলেন, ‘ইরান কখনই পারমাণবিক অস্ত্র এবং তা ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কর্মসূচি বন্ধ করেনি। ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির লক্ষ্য সারা বিশ্বের জন্য একটা হুমকি।’
এই বিশ্বাস থেকে ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে খোঁড়া করে দেওয়ার বা তা বিলম্বিত করে দেওয়ার জন্য গোপনে একপাক্ষিকভাবে অঘোষিত তৎপরতা চালাচ্ছে। ইসরায়েল স্টাক্সনেট সাংকেতিক নাম দিয়ে তৈরি কম্পিউটার ভাইরাস সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যা প্রথম জানা যায় ২০১০ সালে। ওই ভাইরাস ইরানের পরমাণু কেন্দ্রের সেন্ট্রিফিউজ ব্যবস্থাকে অকেজো করে দেয়। এ শতকের গোড়ার দিকে ইরানের বেশ কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানী রহস্যজনকভাবে মারা যান এবং গত বছর নভেম্বর মাসে তেহরানের কাছে ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মহসিন ফখরিজাদেহ-কে হত্যা করা হয়।
মহসিন ফখরিজাদেহ যে শুধু ইরানের শীর্ষ পারমাণবিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন তাই নয়, তিনি ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের (আইআরজিসি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ছিলেন। ইসরায়েলের বিশ্বাস ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সামরিক লক্ষ্যে গড়ে তোলার গোপন কার্যকলাপ তিনিই পরিচালনা করছিলেন।
সেই কর্মসূচি এখন সম্ভবত একটা বিপজ্জনক পর্যায়ে আছে। ইরান ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি পরমাণু চুক্তিতে সই করেছিল যার নাম ছিল জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ)। এই চুক্তিতে তেহরান সই করার পর ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনেন এবং তেহরানের ওপর ফের কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ইরান এরপর ওই চুক্তির শর্ত সময়ে সময়ে লঙ্ঘন করেছে। বিশেষ করে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ করেছে। এভাবে উচ্চ মাত্রায় পরিশোধিত ইউরেনিয়াম পারমাণবিক জ্বালানির জন্য যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি অস্ত্র তৈরিতেও তা ব্যবহারের সম্ভাবনা থাকে।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে আবার এই চুক্তিতে ফিরিয়ে আনতে চান, যদি ইরান চুক্তির শর্ত পুরোপুরি মেনে চলতে সম্মত হয়। ইরান বলছে, ‘না, আমরা তোমাদের বিশ্বাস করি না। তোমরা আগে প্রতিশ্রুতি পূরণ কর। নিষেধাজ্ঞা আগে তুলে নাও, তারপর আমরা চুক্তির শর্ত পুরোপুরি মানবো।’
এই অচলাবস্থা অবসানের চেষ্টায় বেশ কয়েকটি দেশের আলোচনাকারীরা ভিয়েনায় বৈঠক করেছেন। তবে এই চুক্তি বর্তমান আকারে পুনরুদ্ধার করার যুক্তি কতটা আছে তা নিয়ে সন্দিহান ইসরায়েল। লন্ডনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (রুসি)-এর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক ড. মাইকেল স্টিফেন্স বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা ভেস্তে দেওয়ার একটা উদ্দেশ্যমূলক চেষ্টা নিয়েই ইসরায়েল সাম্প্রতিক কার্যকলাপ চালাচ্ছে।
মাইকেল স্টিফেন্স বলেন, ‘ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে লক্ষ্যভ্রষ্ট বা অকেজো করতে ইসরায়েল একপাক্ষিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। কৌশলগত ক্ষমতার দিক দিয়ে তা চমকপ্রদ হলেও এটা কিন্তু একটা ঝুঁকিপূর্ণ খেলা। প্রথমত, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের ফলে আমেরিকার আলোচনায় বসার পরিস্থিতি বিঘ্নিত হতে পারে। বিশেষ করে আমেরিকা যখন ইরানের সাথে আবার নতুন করে চুক্তির চেষ্টা করছে।’
দ্বিতীয়ত, ইরান বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলি স্বার্থ জড়িত এমন কিছুর ওপর এমন ধরনের হামলা চালাতে পারে, যা হবে অসম ক্ষমতার ভিত্তিতে এবং সেটি হয়তো খুব প্রচ্ছন্ন হবে না। ইরানের কর্মসূচি ইসরায়েল যে ব্যাহত করতে পারে সেটা তারা প্রমাণ করে দিয়েছে। কিন্তু সেটার মূল্য কী দাঁড়াবে?
সমুদ্রপথে নৌ চলাচল
সমুদ্রপথে সম্প্রতি রহস্যজনক কিছু ঘটনা ঘটেছে। এ বছরের গোড়ার দিকে ইসরায়েলি মালবাহী জাহাজ এমভি হেলিওস; ওমান উপসাগর দিয়ে যাবার সময় গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাহাজের মূল অংশে হঠাৎ করে দুটি বিশাল গর্ত দেখা যায় এবং ইসরায়েল সঙ্গে সঙ্গেই এর জন্য ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডকে দায়ী করে। তবে তেহরানের দাবি, এতে তাদের কোন হাত ছিল না।
এপ্রিল মাসে সাভিজ নামে ইরানের একটি জাহাজ, যেটি দক্ষিণ লোহিত সাগরে নোঙর করা ছিল, সেটির মূল অংশ কোনও কিছুর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধারণা করা হয়, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ওই ক্ষতি হয়েছে।
নিকটবর্তী ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন ধারণা করছিল সাভিজ ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের জন্য প্রধান সরবরাহকারী জাহাজ হিসেবে কাজ করছিল। তাদের বক্তব্য ছিল ওই মূল জাহাজটিতে স্পিডবোট, মেশিনগান এবং অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম দেখা গেছে। কিন্তু ইরান বলছে, ওই জাহাজটি কোনও সামরিক উদ্দেশ্যে নয়; বরং শান্তিপূর্ণ ও বৈধ উদ্দেশ্যে সেখানে নোঙর করা ছিল। ইরান এই হামলার দায় চাপায় ইসরায়েলের ওপর।
মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, গত ১৮ মাসে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী সিরিয়াগামী ১২টি জাহাজ লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে, যেগুলোতে ইরানের তেল এবং সামরিক সরবরাহ পরিবহন করা হচ্ছি
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়