সম্পদের হিসাব দিতে হবে সব সরকারি চাকরিজীবীকে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত আদেশ জারি হতে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র মো. মোখলেস উর রহমান সমকালকে বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সব সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে। এখন কী পদ্ধতিতে কিভাবে জমা দেবে সে বিষয়ে আমরা ফরম্যাট রেডি করে দেবো।
পাঁচ বছর পরপর সরকারি কর্মচারীর নিজ সম্পদ বিবরণী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার কথা। তবে চাকরির সেই আচরণবিধি আদতে মানছেন না তেমন কেউ। সম্পদের হিসাব দিতে সরকারি চাকরিজীবীর তেমন হেলদোল নেই। তাদের নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থারও হিসাব নেওয়ার ব্যাপারে নেই গরজ। দু’পক্ষের অনীহায় হিসাব দেওয়ার বিষয়টি অনেকটাই ‘কাগুজে নিয়ম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি তাদের অধীন কর্মকর্তাদের দায়সারা হিসাব নেয় বটে, কিন্তু সেগুলো খতিয়ে দেখা হয় না। কারও অস্বাভাবিক সম্পদ বেড়ে গেলেও ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এক মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে কাজ শুরু হলো।
সদ্য সাবেক সরকারের মন্ত্রী এমপি, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ ও এনবিআর থেকে বদলি হওয়া কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর থেকে সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাবের বিষয়টি ফের সামনে এসেছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে দুর্নীতি বেড়েছে বলে জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। বার্লিনভিত্তিক এ সংস্থাটি গত বছর দুর্নীতির যে ধারণা সূচক প্রকাশ করে, সেখানে আগের বছরের চেয়ে দুই ধাপ নিচে নামে বাংলাদেশ। সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন দশম।
জানা গেছে, পাঁচ বছর পরপর সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান ১৯৭৯ সালে চালু হয়। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারী আছেন। চাকরিজীবীর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আচরণ বিধিমালায় এ নিয়ম যুক্ত করা হয়। তবে চার দশকের বেশি সময় ধরে এ নিয়ম পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। অতীতে দেখা গেছে, বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি মন্ত্রণালয় তাদের অধীন কর্মচারীর কাছে সম্পদের বিবরণী চেয়েও তেমন সাড়া পায়নি।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া সমকালকে বলেন, নিয়ম অনুসারে প্রতি পাঁচ বছর পর ডিসেম্বরে সরকারি কর্মচারী তাদের সম্পদের হিসাব জমা দেবেন। আগে তা প্রতিবছর দেওয়ার নিয়ম ছিল। এখন পাঁচ বছরেও অনেকে তা দিতে চান না। তিনি বলেন, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন গড়ে তোলার স্বার্থে এ আচরণবিধি কঠোর ও কঠিনভাবে সরকারের প্রয়োগ করা উচিত। ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী অন্য মন্ত্রণালয় নিশ্চুপ থাকলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যেহেতু আচরণবিধি জারি করেছে, তাই তাদের মুখ্য ভূমিকা নেওয়া উচিত। ফিরোজ মিয়া বলেন, আচরণবিধি না মানলে তা অসদাচরণ। তাই সম্পদের হিসাব না দিলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা উচিত। এতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ভীত হবেন এবং দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ না হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
আচরণ বিধিমালা অনুসারে, নিজ নিজ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার কথা। সরকারি চাকরিতে ক্যাডার রয়েছে ২৬টি। এসব ক্যাডার কর্মকর্তা তাদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করেন। সম্পদের হিসাবও নিজ নিজ মন্ত্রণালয়েই দেওয়ার কথা। ক্যাডার কর্মকর্তার বাইরেও সরকারের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বিপুলসংখ্যক নন-ক্যাডার কর্মকর্তা রয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে সরকারি কর্মচারীর ওপর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার ব্যাপারে কোনো চাপই নেই। ফলে এ সম্পদের প্রশ্নে স্রোতে গা ভাসিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সবাই। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সম্পদের হিসাব জমা দিতে কড়া নির্দেশ দেওয়া হলে সে সময় সব কর্মচারী তা দিয়েছিলেন। নানা দিকে আলোচনা উঠলে ২০১৫ সালে আরেক দফা সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জমা দিতে সরকার থেকে বলা হয়। তখন গুটিকয়েক মন্ত্রণালয় তাদের নিয়ন্ত্রিত কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নিতে পারলেও বেশির ভাগই ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে সরকারি চিকিৎসকদের সম্পদের হিসাব চাওয়া নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তখন বেশ বিপাকে পড়ে। চিকিৎসকের মধ্য থেকে এর জোরালো প্রতিবাদও ওঠে।
জানা গেছে, সরকারি কর্মচারীকে আচরণবিধি মানাতে না পেরে গত বছরের শেষের দিকে এ নিয়ম বদলে ফেলার উদ্যোগ নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরে আচরণবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা (ধারা-১২ ও ১৩) সংশোধনের বিষয়টি সমালোচনার মুখে পড়লে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়।
একইভাবে মন্ত্রী-এমপির সম্পদ বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশ করার কথা থাকলেও তা দীর্ঘদিন বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। নির্বাচনের আগে প্রার্থী হিসেবে অনেকে যে হলফনামা নির্বাচন কমিশনে জমা দেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুসারে তা প্রকাশ করা হয় বটে। তবে সেখানে সম্পদের যে বিবরণ থাকে, এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে।
সরকারি কর্মচারী আইন (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর বিধি ১২ ও ১৩ অনুসারে সরকারি কর্মচারীর স্থাবর সম্পত্তি অর্জন, বিক্রি ও সম্পদ বিবরণী জমার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটসহ যে কোনো সম্পদ কিনতে বা বিক্রি করতেও সরকারের অনুমতি নিতে হয় তাদের। সম্পদ কেনার ক্ষেত্রে টাকার উৎস সম্পর্কেও জানাতে হয়। আবার সম্পদ বিক্রি করা হলে দাম জানাতে হয়। কারণ, কমবেশি দামে সম্পদ বেচাকেনা হলো কিনা, তা যাচাই করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
অভিযোগ আছে, একশ্রেণির সরকারি কর্মচারী তাদের আয়কর রিটার্ন বা এনবিআরে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে প্রকৃত সম্পদ দেখান না; বেনামে সম্পদ লুকিয়ে রাখেন। প্রতিটি আয়কর রিটার্ন ফরমের সঙ্গে আইটি ১০বি নামে একটি আলাদা ফরম থাকে। ওই ফরমেই সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হয়। সম্পদ বিবরণী জমার তিনটি শর্ত আছে। সে অনুযায়ী সম্পদের পরিমাণ ৪০ লাখ টাকা পার হলে, গাড়ির মালিক হলে এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় জমি-বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট থাকলে সম্পদ বিবরণী জমা বাধ্যতামূলক।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, প্রশাসন ক্যাডারে চাকরিতে ঢোকার সময় নবীন কর্মকর্তারা শুরুতেই তাদের সম্পদের বিবরণী জমা দেন। প্রতি পাঁচ বছর পরপর সম্পদের হিসাবও তারা দেন। তবে অন্য ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়গুলো এ নিয়ে উদাসীন থাকায় তাদের কর্মকর্তারা সম্পদের হিসাব দেন না।
একাধিক সাবেক সচিব সমকালকে বলেন, আগে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া ছাড়াও নিজ নিজ দপ্তরে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জমা বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারে সরকার গুরুত্ব দিয়েছিল। সরকারের এবারের লক্ষ্য, তাদের নিজ নিজ দপ্তরে সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়া থেকে অব্যাহতি দেওয়া। যেসব সরকারি কর্মচারী আয়কর বিবরণী জমা দেবেন, তাদের নিজ নিজ দপ্তরে তথা সরকারের কাছে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া থেকে অব্যাহতি দেওয়া কতটা যৌক্তিক হবে, তা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। তারা জানান, সম্পদের হিসাব দাখিলের নিয়ম শিথিল করে আচরণ বিধিমালায় সংশোধনী আনা অযৌক্তিক। আয়কর অফিসে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া এবং সরকারি কর্মচারীর নিজ দপ্তরে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমার উদ্দেশ্য এক নয়। আয়কর অফিসের লক্ষ্য কর আদায় করা। দুর্নীতি দমন কমিশন বা অন্য কোনো সরকারি সংস্থা কোনো সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব না চাইলে আয়কর অফিসের রিটার্নদাতার সম্পদের উত্থানের বিষয়ে তেমন উদ্বেগ থাকে না।
এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার সমকালকে বলেন, লাখ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর আয়কর রিটার্ন খতিয়ে দেখার মতো সক্ষমতা সরকারের কোথায়? তাই নিজ কর্তৃপক্ষের কাছে সম্পদের হিসাব দেওয়ার দায় কোনোভাবেই এড়ানো যায় না। তিনি বলেন, কেউ বিবেকহীন হলে আসলে কোনো বিধিবিধান দিয়ে তাকে আটকানো যায় না। সম্পদের হিসাব দেওয়ার জন্য সরকারি চাকুরের মধ্যে তদারকি ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়