ফরাসি লেখক ও দার্শনিক ভলতেয়ার ১৭৯৪ সালে লিখেছিলেন, ‘তুমি যদি একজন সুইস ব্যাংকারকে জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিতে দেখো, তাহলেও তাকে অনুসরণ করো, নিশ্চিত জেনো সেখানে অবশ্যই মুনাফা করার মতো কিছু আছে।’
সুইজারল্যান্ডের অনেক সুনাম আছে। সুইস চকলেট পৃথিবীসেরা। ভারী শিল্পেও দেশটির সুনাম আছে। পনির খেতে হলে যেতে হবে সুইজারল্যান্ডে। দেশটিকে বিশ্বের ব্যাংক খাতের রাজধানী বলা হয়। এবার একটু দুর্নামও করা যাক। কালোটাকা গোপন রাখার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জায়গা কিন্তু সুইজারল্যান্ড। সুইস ব্যাংকের সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি বিশ্বজোড়া।
ব্যাংক গ্রাহকদের তথ্য গোপন রাখাটাই এ দেশের আইন। এ কারণেই আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়াসহ তৃতীয় বিশ্বের দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক শাসক-স্বৈরশাসক, রাজনীতিবিদ এবং উন্নত বিশ্বের অসাধু ব্যবসায়ীদের অর্থ লুকিয়ে রাখার বড় জায়গা এই সুইস ব্যাংক। অর্থ বা সম্পদ লুকিয়ে রাখার জন্য এর চেয়ে বড় জায়গা পৃথিবীতে নেই।
ইদানীং অবশ্য প্রশ্ন উঠছে, চাপও বাড়ছে সুইস ব্যাংক ব্যবস্থার ওপরে। ফলে গোপনীয়তা আইন থেকেও খানিকটা সরে আসতে হয়েছে সুইজারল্যান্ডকে। বছর শেষে গচ্ছিত অর্থের হিসাব প্রকাশ করে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে বাংলাদেশের নাগরিকদের রাখা ব্যাংক হিসাবের তথ্যও পাওয়া যায়। এটাও এক ধরনের অগ্রগতি। তবে এখন অনেক দেশই গ্রাহকের তথ্য পাওয়ার চুক্তিও করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে তবে কি সুইস ব্যাংক তার জৌলুশ হারাচ্ছে? সুইজারল্যান্ড কি আর অর্থ গোপন রাখার নিরাপদ জায়গা নয়?
সুইস ব্যাংক: যেভাবে শুরু
সুইস ব্যাংকব্যবস্থার ইতিহাস বেশ পুরোনো। সুইস ব্যাংক, গোপন অর্থ আর গোপনীয়তা—এই তিন বিষয়ও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আর এই গোপনীয়তার শুরু সপ্তদশ শতকের শুরু থেকেই। মূলত তখন ইউরোপের অভিজাত শ্রেণিকে রক্ষা করার জন্যই ১৭১৩ সালে গ্রেট কাউন্সিল অব জেনেভা ব্যাংক গোপনীয়তা আইন প্রণয়ন করেছিল। এখানে অবশ্য ধর্মেরও একটা ভূমিকা ছিল। পাশের দেশ ফ্রান্সের ব্যাংকগুলো ছিল মূলত খ্রিষ্টীয় ধর্মের প্রোটেস্ট্যান্টদের দখলে। ক্যাথলিকেরা এসব ব্যাংকে অর্থ রাখতে আগ্রহী ছিলেন না। ফ্রান্সের সে সময়ের ক্যাথলিক রাজাও তখন সুইস ব্যাংকগুলোতে অর্থ রাখা শুরু করেন। ১৭৮০ সালের দিকে সুইস ব্যাংকে রাখা অর্থ বিমার আওতায় নিয়ে এলে আর্থিক নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার হয়। ১৮১৫ সালে সুইজারল্যান্ড একটি নিরপেক্ষ দেশের মর্যাদা পেলে সুইস ব্যাংকে অর্থপ্রবাহ অনেক বেড়ে যায়।
ছোটখাটো এক গৃহযুদ্ধের পরে ১৮৪৮ সালে গঠিত হয় সুইস ফেডারেশন। শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক কাঠামো দেশটিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেয়, যা ব্যাংকের গোপনীয়তা নীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। নিরপেক্ষ দেশ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে আছে ব্যাংক গ্রাহকদের তথ্য গোপন করার নীতি, ফলে সুইস ব্যাংকগুলোর ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে।
ব্যবসা রমরমা বিশ্বযুদ্ধে
মূলত দু–দুটি বিশ্বযুদ্ধই সুইস ব্যাংকের ব্যবসাকে রমরমা করে তুলেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই সুইস ব্যাংকাররা নিজ নিজ ব্যাংকের বিজ্ঞাপন প্রচারে ফ্রান্স সফর শুরু করেন। লক্ষ্য, দেশটির অভিজাত ও ধনী শ্রেণি। আর বিজ্ঞাপনে মূল আকর্ষণ হিসেবে ব্যাংক গোপনীয়তা আইনের কথাই প্রচার করা হতো। যুদ্ধ অনিশ্চয়তা তৈরি করে, যা অর্থনৈতিক সংকটের বড় কারণ। এর ফলে সুইস ব্যাংকগুলোতে প্রচুর অর্থ আসা শুরু হয়। আবার যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহে ইউরোপের অনেক দেশই নতুন যুদ্ধকর আরোপ করেছিল। এতে সুইস ব্যাংকগুলোর ব্যবসা আরও বেড়ে যায়। কর ফাঁকি দিতেই এ সময় ধনী ব্যক্তিরা সুইস ব্যাংকে ভিড় বাড়াতে থাকেন।
সুইস ব্যাংক গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগোয় ১৯৩৪ সালে। এর আগে ব্যাংকের গ্রাহকের তথ্য ফাঁস করলে তা দেওয়ানি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। সুইস ফেডারেল অ্যাসেম্বলি নতুন আইন করে। এই আইনে গ্রাহকের তথ্য ফাঁস ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা শুরু হয়। ব্যাংক গ্রাহকদের তথ্য গোপন রাখার ক্ষেত্রে নতুন এই আইনকে একটি মাইলফলক হিসেবেই মনে করা হয়। সে সময় ফ্রান্স ও জার্মানি নিজের দেশের নাগরিকদের কর ফাঁকি বন্ধে সুইস ব্যাংকগুলোর শাখায় অভিযান চালিয়েছিল। এতে অনেক গোপন নাম ফাঁস হয়ে যায়। ফলে গোপনীয় আইন আরও কঠোর করা হয়।
হিটলারও অর্থ রাখতেন
জার্মানিতে নাৎসি দল ও হিটলারের উত্থান এবং তাঁর ইহুদিবিরোধী মনোভাব সুইস ব্যাংকগুলোর ব্যবসা আরও বাড়িয়ে দেয়। সুইস ব্যাংকগুলো এ সময় নাৎসিদের হাত থেকে ইহুদিদের সম্পদ রক্ষার কাজটি করে। অবশ্য এর সঙ্গে ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত। ধনী ইহুদিরা তাঁদের সম্পদ সুইস ব্যাংকগুলোতে রাখা শুরু করেন। আবার একই সঙ্গে তাঁরা নাৎসি ও তাঁদের সহযোগীদের অর্থ এবং সোনা মাটির নিচে ভল্টে রাখার ব্যবস্থাও নেন। বলা হয়, ইহুদি নিধনের আগে নাৎসি নেতারা তাঁদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে সুইস ব্যাংকগুলোতে লুকিয়ে রাখতেন। এমনকি সুইস ব্যাংকে রাখা সম্পদ নিজের নামে জোর করে লিখিয়ে নিয়েছিলেন অনেক নাৎসি প্রভাবশালী সদস্য।
অ্যাডলফ হিটলারও ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ডে (ইউবিএস) অর্থ রেখেছিলেন। এর পরিমাণ ছিল ১১০ কোটি রেইচমার্ক (সে সময়ে জার্মানির মুদ্রা, ১৯৪৮ সালে তা বদলে ডয়েসমার্ক হয়)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইহুদিদের সম্পদ উদ্ধারে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হলে চাপ বাড়ে সুইস ব্যাংকগুলোর ওপর। এর ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে হিটলারের জমা রাখা অর্থ ফেরত চায়। ইউবিএস ৭০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ফেরতও দেয়। মালিকানা না থাকলে এবং তা জব্দ করা হলে কী পরিমাণ অর্থ কোনো কর্তৃপক্ষকে ফেরত দেওয়া হবে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট আইন আছে। বলা হয়, নাৎসিবিরোধীদের সম্পদ রক্ষা করছে বলে হিটলার ১৯৪০ সালে সুইজারল্যান্ড দখল করার কথাও ভেবেছিলেন। যদিও পরে তা আর কার্যকর করেননি।
ক্রিস্টোফ মেইলি এক সময় ইউবিএসের নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন। ১৯৯৭ সালে তিনি হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে তথ্য দেন যে ব্যাংকটি ইহুদি গণহত্যা বা হলোকস্ট সময়ের সব ধরনের নথি পুড়িয়ে ফেলেছিল, যাতে গচ্ছিত সম্পদের মালিকানার প্রমাণ না থাকে। এ নিয়ে একাধিক মামলা হলে হত্যার শিকার ইহুদিদের পরিবারের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসতে হয়। এ জন্য ইউবিএসকে ১২৫ কোটি ডলার দিতে হয় আর ক্রিস্টোফ মেইলি পান সাড়ে সাত লাখ ডলার।
বার্কেনফিল্ডের গল্প
পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হওয়ার পরে। এ সময় সুইস ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ বাড়তে থাকে। আবার ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ব্যাংকের গোপনীয়তা আইন ভঙ্গের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়। কিন্তু তার আগেই বড় ধাক্কাটি দেয় আরেক মার্কিন নাগরিক।
ঘটনাটি ২০০৭ সালের। ব্র্যাডলি বার্কেনফিল্ডের গল্পটা ‘বার্কেনফিল্ড ডিজক্লোজার’ নামে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। বলা যায়, সুইস ব্যাংকের রমরমা ব্যবসা কমিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্র্যাডলি বার্কেনফিল্ড সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন। মার্কিন নাগরিক বার্কেনফিল্ড কাজ করতেন সুইস ব্যাংক ইউবিএস-এ। তিনিই প্রথম সুইস ব্যাংকিং সিক্রেসি আইন ভেঙেছিলেন। ২০০১ সালে তিনি জেনেভায় ইউবিএসে যোগ দিয়েছিলেন সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়ে। আর ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেছিলেন ২০০৫ সালে। এর আগে তিনি ব্যাংকের করা কিছু অভ্যন্তরীণ নথি দেখেছিলেন, যা তৈরি করেছিল ব্যাংকটির আইন বিভাগ। নথিতে মার্কিন গ্রাহকদের নিয়ে কাজ করেন, এমন সম্পদ ব্যবস্থাপকদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল।
নথিতে বলা ছিল, এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে প্রতিষ্ঠান দায়ী থাকবে না, সব দায় নিতে হবে সম্পদ ব্যবস্থাপকদের। এ নিয়ে আপত্তির কথা বার্কেনফিল্ড ঊর্ধ্বতনদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো সাড়া পাননি। এরপরই তিনি পদত্যাগ করেন। কেননা, মার্কিন নাগরিকদের সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখার ব্যবস্থা বার্কেনফিল্ডই করতেন। আর ধনী আমেরিকানদের আকৃষ্ট করতে সুইস ব্যাংকগুলো ইয়ট রেসসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করত।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়