আকারে বড় হলেও দুর্বল হয়েছে অগ্রণী ব্যাংক

গত এক যুগে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের সম্পদের আকার চার গুণ বড় হয়েছে। এ সময়ে ব্যাংকটির ব্যবসার পরিধিও বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু সম্পদ ও ব্যবসা বাড়লেও ব্যাংকটির ভিত নড়বড়ে হয়েছে । রেকর্ড খেলাপি ঋণ, মূলধন ও সঞ্চিতি ঘাটতিসহ ব্যাংকিংয়ের মৌলিক প্রতিটি সূচকে দুর্বল হয়ে পড়েছে ব্যাংকটি।

অগ্রণী ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১০ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের মোট সম্পদ ছিল ২৬ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। এক যুগ পর ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির সম্পদের আকার ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ হিসাবে গত এক যুগে ব্যাংকটির সম্পদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৩৫ শতাংশ। সম্পদের আকার চার গুণ বাড়লেও ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে। ২০১০ সালে অগ্রণী ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ৩৫১ কোটি টাকা। আর গত বছর ব্যাংকটি মাত্র ১৪১ কোটি টাকা নিট মুনাফা দেখাতে পেরেছে। যদিও এ মুনাফা দেখানো হয়েছে কৃত্রিমভাবে।

২০২২ সাল শেষে ৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকার প্রভিশন বা সঞ্চিতি ঘাটতিতে ছিল অগ্রণী ব্যাংক। আইন অনুযায়ী, সঞ্চিতি ঘাটতিতে থাকলে কোনো ব্যাংকের নিট মুনাফা দেখানোর সুযোগ নেই। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নীতি ছাড় নেয়া হয়েছে। আগামী চার বছরে ব্যাংকটিকে ঘাটতি থাকা সঞ্চিতি পূরণের শর্ত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে ব্যাংকটি নিট মুনাফা দেখিয়ে নিজেদের আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে চেয়েছে।

শুধু নিট মুনাফা পরিস্থিতিই নয়, বরং গত এক যুগে ব্যাংকটির আর্থিক ভিতও ভঙ্গুর হয়ে উঠেছে। ২০২২ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার ৪০৮ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ২১ দশমিক ১১ শতাংশই এখন খেলাপি। এর বাইরে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য ৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে ব্যাংকটি। যদিও এক যুগ আগে ২০১০ সালে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ১০২ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১২ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

গত বছর শেষে অগ্রণী ব্যাংক ২ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকটির ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের হার (সিআরএআর) ন্যূনতম সাড়ে ১২ শতাংশ হওয়ার কথা। যদিও এক্ষেত্রে ব্যাংকটির সিআরএআর রয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। অথচ এক যুগ আগে সঞ্চিতি সংরক্ষণ ও মূলধনের দিক থেকে বেশ স্বাবলম্বী ছিল অগ্রণী ব্যাংক।

২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে টানা প্রায় নয় বছর অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে আছেন অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত। এ সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে ব্যাংকটির একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক অপসারিত হয়েছেন। আরেকজন টানা ছয় বছর এমডির দায়িত্ব শেষে অবসরে গিয়েছেন। আর বর্তমান এমডি দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় এক বছর ধরে।

ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জায়েদ বখত বলেন, ‘গ্রাহকরা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। এ কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। গত তিন বছরে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংক দেশের অর্থনীতির স্বার্থে গ্রাহকদের ঋণ দিয়েছে। ডলারের চাপ সত্ত্বেও সরকারি-বেসরকারি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলেছে। কভিড মহামারীসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্তেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। অপ্রত্যাশিত এ যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির বিরূপ প্রভাবই অগ্রণী ব্যাংকের গ্রাহকদের ওপর পড়েছে।’

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেকে সফল নাকি ব্যর্থ মনে করেন জানতে চাইলে জায়েদ বখত বলেন, ‘এক্ষেত্রে উত্তর হলো মিশ্র। অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ বিতরণে টুকটাক সমস্যা থাকতে পারে। বড় কোনো গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি এ ব্যাংকে ঘটেনি। ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি স্বাধীনভাবে কাজ করেছি। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাজে কখনো হস্তক্ষেপ করিনি। আমরা খেলাপি ঋণের হার ১২ শতাংশে নামিয়ে এনেছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতির কারণেই সেটি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।’

অগ্রণী ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১০ সালে ব্যাংকটির আমানত ছিল ২০ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। ওই সময় ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ১৬ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। এত স্বল্প পরিমাণ বিনিয়োগ সত্ত্বেও বছরটিতে অগ্রণী ব্যাংক সুদ খাত থেকে আয় করেছিল ৬৯১ কোটি টাকা। বিপরীতে ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ৯৩ হাজার ৮৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। একই সময়ে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৭৩ হাজার ৬ কোটি টাকা। এত বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ সত্ত্বেও গত বছর সুদ খাত থেকে মাত্র ৪৭৬ কোটি টাকা আয় করতে পেরেছে ব্যাংকটি, যা এক যুগ আগের সুদ খাত থেকে আয়ের চেয়েও ২১৫ কোটি টাকা কম। এর আগে ২০২১ সালে সুদ খাত থেকে কোনো অর্থই আয় করতে পারেনি ব্যাংকটি। উল্টো ওই বছর সুদ খাতে ৭৪৪ কোটি টাকা লোকসান গুনেছিল ব্যাংকটি।

যেকোনো ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস সুদ খাত। কিন্তু বিতরণকৃত ঋণের প্রায় অর্ধেক থেকেই সুদ বাবদ কোনো আয় নেই অগ্রণী ব্যাংকের। ব্যাংকটির আয়ের প্রধান উৎস এখন সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ ও বিভিন্ন ধরনের ফি ও কমিশন। অগ্রণী ব্যাংকে এখন যে পরিমাণ অর্থ ঢুকছে, তার চেয়ে বেশি অর্থ বের হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির পরিচালন কার্যক্রমে নগদ প্রবাহ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ১১ কোটি টাকা।

২০১০ সালের মার্চে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে সৈয়দ আবদুল হামিদকে নিয়োগ দেয়া হয়। তার নেতৃত্বে ব্যাংকটিতে অনিয়ম-দুর্নীতি ব্যাপকতা পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকটির নাম আসতে থাকলে ২০১৬ সালের জুনে তাকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর মো. শামস-উল-ইসলামকে ব্যাংকটির এমডি পদে নিয়োগ দেয়া হয়। দুই মেয়াদে টানা ছয় বছর দায়িত্ব পালনের পর গত বছর অবসরে যান তিনি। ২০২২ সালের অক্টোবরে মুরশেদুল কবীর ব্যাংকটির এমডি পদে নিয়োগ পান।

অগ্রণী ব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিযোগ, আবদুল হামিদের সময় অগ্রণী ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতি জেঁকে বসেছিল। এরপর শামস-উল-ইসলামের সময়ে সেটি আরো বিস্তৃত হয়। এমডি হিসেবে নিজের পদ ধরে রাখার পাশাপাশি মেয়াদ বাড়ানোয় তার মনোযোগ ছিল বেশি। এর অংশ হিসেবে বড় করপোরেটদের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানকে বাছবিচার ছাড়া ঋণ দিয়েছেন তিনি। সেসব ঋণই এখন ব্যাংকটির দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে দুঃখ হয় বলে জানালেন ব্যাংকটির সাবেক এমডি সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ। ২০০৪ থেকে ১০১০ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকটির এমডির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব পালনের সময় অগ্রণী ব্যাংককে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকে উন্নীত করেছিলাম। কিন্তু পরে সেটি আর ধরে রাখা যায়নি। অর্থনীতিবিদ ও গবেষক হিসেবে ড. জায়েদ বখতের সুনাম ছিল। কিন্তু ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি আপস করেছেন বলেই মনে হয়। তা না হলে অগ্রণী ব্যাংকের পরিস্থিতি এমন হওয়ার কথা ছিল না। ২০১০ সাল-পরবর্তী দুই এমডি নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। প্রভাবশালীদের দাবির বিপরীতে তাদের না বলার ক্ষমতা ছিল না। এ কারণেই অগ্রণী ব্যাংক এতটা খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছে। ব্যাংকটিকে টেনে তুলতে হলে যোগ্য নেতৃত্ব ও পরিচালনা পর্ষদ দরকার।’
এই বিভাগের আরও খবর
এস আলমের শেয়ার বিক্রি করে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে: ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান

এস আলমের শেয়ার বিক্রি করে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে: ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান

প্রথমআলো
ব্যাংকের ওপর আস্থা কমায় টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনছে মানুষ

ব্যাংকের ওপর আস্থা কমায় টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনছে মানুষ

কালের কণ্ঠ
বিদ্যুৎ নিয়ে আদানির সাথে হওয়া চুক্তি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট

বিদ্যুৎ নিয়ে আদানির সাথে হওয়া চুক্তি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট

নয়া দিগন্ত
প্রাইম ব্যাংক ও সেবা ডট এক্সওয়াইজেডের মধ্যে চুক্তি সই

প্রাইম ব্যাংক ও সেবা ডট এক্সওয়াইজেডের মধ্যে চুক্তি সই

বাংলা ট্রিবিউন
ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু

ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু

বাংলা ট্রিবিউন
ভারতে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম, কেজি উঠেছে ৭০–৮০ রুপিতে

ভারতে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম, কেজি উঠেছে ৭০–৮০ রুপিতে

প্রথমআলো
ট্রেন্ডিং
  • সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে 'বস্তায় বস্তায় ঘুষ' নেওয়ার অভিযোগ: দুদকের অনুসন্ধান শুরু

  • ভালোবাসা দিবসে পরী মনির ‘বুকিং’

  • নির্বাচনের আগে পাকিস্তানে জোড়া বিস্ফোরণে নিহত ২৮

  • ভিসা পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে নিলো যে দেশ

  • শন্তিপূর্ণভাবে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি: প্রধানমন্ত্রী

  • ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের পারমাণবিক অস্ত্র বাড়বে তিন গুণ

  • তানজানিয়ায় প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৯

  • ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার বেশি থাকলে বেশি কর

  • কাতার বিশ্বকাপে ফিরছে জিদানের সেই ভাস্কর্য

  • ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞায় তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া