চাহিদার তুলনায় চালের ঘাটতি মেটানো হয় আমদানির মাধ্যমে। চলতি বছরও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৯ লাখ ১০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এজন্য চালের পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিতে আমদানিতে শুল্ক সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এর পরও গত চার মাসে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ চাল আমদানি হয়নি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় সাত লাখ টনের ঋণপত্র খুললেও আমদানির সাহস পাচ্ছে না। মূলত ভারতে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকা ও ডলারের বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতাকে এক্ষেত্রে কারণ বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে মজুদ নিশ্চিত না হলে আগামীতে দেশে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা রয়েছে এমন পূর্বাভাস বিশেষজ্ঞদের।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) সূত্র মতে, ২০২১-২২ বিপণন বর্ষে (মে-এপ্রিল) দেশে ১ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়। আর ২০২২-২৩-এ প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে মোট ৩ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদন হবে। সুতরাং গত বছরের তুলনায় প্রায় দুই লাখ টন চাল কম উৎপাদন হতে পারে।
২০২১-২২-এ বোরো মৌসুমে ৪৭ লাখ হেক্টর জমিতে চাল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯৩ লাখ ৫০ হাজার টন। আউশ মৌসুমে ১১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে ২৭ লাখ টন এবং আমন মৌসুমে ৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৩৮ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়। আর ২০২২-২৩-এ বোরো মৌসুমে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৯৭ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়।
বোরো মৌসুমে উৎপাদন বাড়লেও চলতি বছরের জুনে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে আউশ মৌসুমের আবাদ কমে যায়। ফলে এ বছর নয় লাখ হেক্টর জমিতে ২০ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদনের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। সে হিসেবে গত বছরের তুলনায় এ বছর আউশ উৎপাদন কমছে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টন। আর আমন মৌসুমে ৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৩৯ লাখ টন চাল উৎপাদনের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করতে চলতি বছরের জুনে বেসরকারিভাবে চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয় সরকার। এ সময় আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নিয়ে আসা হয়। তবুও আমদানির পরিমাণ সন্তোষজনক না হওয়ায় আগস্টে চালের শুল্ক আরো কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
দেশের বাজারে চালের মূল্য কমাতে চলতি বছর প্রায় ৯ লাখ ১০ হাজার টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এজন্য ৩২৯টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক ছাড়ে চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। তবে কয়েক দফায় শুল্ক কমানোর পর ঋণপত্র খুললেও চাল আমদানি করছে না বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ১ জুলাই থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত—এ চার মাসে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৬১ হাজার ২৭০ টন। আর সরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে সাড়ে ২৩ হাজার টন।
দেশে চাহিদা অনুপাতে মজুদ না থাকলেও আমদানির অনুমতি নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর চাল আমদানির পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। এর কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, একসময় চাল আমদানির জন্য কোনো অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল না। গত কয়েক বছর সরকার আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী অনুমোদন দিচ্ছে। চাল আমদানির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে এটি।
অন্যদিকে, ঋণপত্র খোলার পর যে দামে চাল দেশে প্রবেশ করছে তার বিপরীতে ব্যাংকের দায় পরিশোধে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে এ পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে তাদের। ডলারের অস্থিতিশীল বিনিময় হার ও ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক চালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ঋণপত্র খুলতেও অনীহা দেখাচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশের বেশকিছু আমদানিকারক ব্যবসায়ী।
ব্যাংকগুলো ঋণপত্র খোলার পরও অনুমোদন পাওয়ার দীর্ঘসূত্রতায় ব্যবসায়ীরা চাল আমদানিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের অনেকেই অনুমোদন পেলেও চাল আমদানির ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে দেয়া সরকারি অনুমতিপত্রের বিপরীতে চাল আমদানি করে বড় লোকসানের মুখে পড়েছেন অনেক ব্যবসায়ী।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রামের চাক্তাই পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ওমর আজম বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকগুলোয় ঋণপত্র খুলতে অনীহা, ঋণপত্র অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা ছাড়াও প্রতিনিয়ত ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে নিত্য এ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে লোকসানের ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধান উৎপাদনকারী দেশ। আমদানীকৃত চাল দেশে প্রবেশের মুহূর্তে যদি কোনো মৌসুমের ধান উত্তোলন মৌসুম শুরু হয় তখন আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে দেশীয় চালের প্রতিযোগিতায় ব্যবসায়ীদের লোকসানের ঝুঁকি থাকে। যার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে চালের আমদানিতে অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারিয়েছেন।
গত এক বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারিভাবে চালের আমদানিতে দুই দফায় প্রায় ৪৭ শতাংশ শুল্ক ছাড় দেয়া হয়েছে। ডলারের দাম বাড়লেও শুল্ক মওকুফে ব্যবসায়ীদের বেশি হারে ছাড় দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে বেসরকারি একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বলেন, চাল ব্যবসায়ীরা কথায় কথায় এমন অজুহাত দিয়ে এর আগেও বাজারে দাম বাড়িয়েছে। এখনো তারা হয়তো ওই একই প্রক্রিয়ায় অজুহাত দেখিয়ে সংকট তৈরি করার চেষ্টা করছে। যাতে তারা বাজারকে অস্থিতিশীল করে টাকা আয় করতে পারে। আমরা এর আগে চাল, চিনি, তেলের ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিযোগ শুনেছি।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সরকারি ঋণপত্রগুলো (এলসি) করা হয়। এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য আমদানি করতে খাদ্য অধিদপ্তরের একাধিক এলসি সোনালী ব্যাংকে খোলা হয়েছে। অন্যান্য ব্যাংকও এ-সংক্রান্ত এলসি খুলছে। খাদ্য অধিদপ্তর বৈশ্বিক বাজারমূল্য এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পর্যালোচনা করেই খাদ্য আমদানি করছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি নিয়ে যেসব যুক্তি দিচ্ছে তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত সেটা ভেবে দেখা দরকার। এরই মধ্যে ডলারের মূল্যও সহনীয় পর্যায়ে আসতে শুরু করেছে।
হিলি স্থলবন্দরের চাল আমদানিকারক মামুনুর রশীদ বলেন, চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি দেয়। তখন দুই হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি পেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার শুল্ক কমানোর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। যার ফলে আমরা আশানুরূপ লাভ পাচ্ছি না। এ কারণে হিলি স্থলবন্দরের অনেক আমদানিকারক অনুমতি পেলেও এখন চাল আমদানি করছেন না।
এলসি খুললেও একই কারণে চাল আমদানি করছেন না জানিয়ে হিলি স্থলবন্দরের আরেক চাল আমদানিকারক ললিত কেশেরা বলেন, চাল আমদানির অনুমতি পেলেও এবার লাভ নেই। এ কারণে আমদানিতে তেমন একটা আগ্রহ নেই। অনুমতি পাওয়ার পর ২০০ টনের মতো চাল আমদানি করেছিলাম। কিন্তু দেশী চালের চেয়ে ভারতীয় চালের দাম বেশি হওয়ায় লোকসানে সেসব চাল বিক্রি করতে হয়েছে। এর পরও সে সময় ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। তার পরও লোকসান হয়েছে। আর এখন তো ডলারের দাম ১০৬-১০৭ টাকা। এতে আরো বেশি লোকসান গুনতে হবে। আবার দেশের বাজারে চালের চাহিদা তেমন নেই, যার কারণে চালের বেচাকেনাও তেমন নেই। এ কারণে চাল আমদানি বন্ধ রেখেছি।
হিলি স্থলবন্দর আমদানি রফতানিকারক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ও চাল আমদানিকারক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, হিলি স্থলবন্দরের বেশ কয়েকজন আমদানিকারক ৬০-৭০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি পেয়েছেন। এর মধ্যে গুটিকয়েক আমদানিকারক চাল আমদানি করছেন, যারা কিনা চালের এলসি খুলেছিলেন। কিন্তু যারাই চাল আমদানি করেছেন তারাই বিপাকে পড়েছেন। চালের আমদানি শুল্ক কমানো হলেও ভারতে চালের দাম কমেনি, উল্টো দাম বেড়ে যায়। বর্তমানে ওএমএসের মাধ্যমে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১৫ টাকা কেজি দরে সরকার চাল দেয়ায় বাজারে চালের বিক্রি তেমন নেই। এছাড়া সরকার বিভিন্ন চালের মিলে নজরদারি বাড়ানোর কারণে তাদের মিলে যে চালের মজুদ ছিল, সেগুলো ছেড়ে দেয়ায় বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়