২০১৬ সালের ২৬ অক্টোবর রবি আজিয়াটা লিমিটেড ও এয়ারটেল বাংলাদেশ লিমিটেড একীভূতকরণের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। বিটিআরসির দেয়া অনুমতিতে একীভূতকরণের পর সব পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপন এবং বাজারজাতে রবি আজিয়াটা লিমিটেড নাম ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার দেয়া শর্ত পূরণ না করে আগের মতোই রবি ও এয়ারটেল নামে দুটি ব্র্যান্ডের পণ্য ও সেবা বাজারজাত করছে কোম্পানিটি।
রবি ও এয়ারটেল একীভূতকরণ অনুমোদন দেয়া হয় ২০১৬ সালের ২৬ অক্টোবর। ওই প্রজ্ঞাপনের ২০ নম্বর শর্তে বলা হয়, একীভূতকরণের পর একীভূত কোম্পানিকে রবি আজিয়াটা লিমিটেডের নামেই সব পণ্য বা সেবার বিজ্ঞাপন বাজারজাত করতে হবে।
তবে এয়ারটেল বাংলাদেশ লিমিটেডের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, এয়ারটেল ব্র্যান্ডের নামে আলাদা রিচার্জ অফার, ইন্টারনেট সেবা, রোমিং সেবা, ইন্টারন্যাশনাল কল ট্যারিফ, এয়ারটেল বিকাশ অটো রিচার্জ, এয়ারটেল নেটওয়ার্ক টাওয়ার, ই-স্পোর্টস এবং গেমিং ও ভোল্টে সেবার বিজ্ঞাপন দেয়া রয়েছে। কোম্পানিটির ওই সাইটে প্রবেশের জন্য রবি নাম্বারের মাধ্যমে লগইনের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
রবির পক্ষ থেকে এয়ারটেলকে সাব-ব্র্যান্ড দাবি করা হলেও এয়ারটেলের ওয়েবসাইটে এয়ারটেলকে একটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড হিসেবে দাবি করা হয়। ব্র্যান্ডটি সম্পর্কে বলা হয়, ‘এয়ারটেল ভারতী এন্টারপ্রাইজের একটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড, যা গ্রাহক সংখ্যায় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর। মালয়েশিয়ার আজিয়াটা গ্রুপ ও ভারতের ভারতী এন্টারপ্রাইজ ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি কোম্পানিটিকে একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৬ নভেম্বর ২০১৬ থেকে একীভূত কোম্পানি হিসেবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে রবি। রবি ও এয়ারটেলের একীভূতকরণের ফলে রবি বাংলাদেশের গ্রাহকদের জন্য ০১৬ সিরিজের এয়ারটেল ব্র্যান্ড ব্যবহারের লাইসেন্স সনদ পেয়েছে।’
জানতে চাইলে কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চুক্তিতে যদি এয়ারটেলের নাম ব্যবহারের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা না হয় এবং রবি নাম ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা থাকে তাহলে তারা এয়ারটেল ব্র্যান্ড ব্যবহার করতে পারবে না। এ ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা কন্টাক্ট ল ভঙ্গ করেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি ও ব্যবস্থা নেয়নি তার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দায়ী করতে হবে।’
এর আগে ২০২২ সালে এয়ারটেল নামে ভয়েস ও ডাটার (ইন্টারনেট) প্যাকেজের প্রচার-প্রসারের জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যম, ডিজিটাল প্লাটফর্মে দেয়া বিজ্ঞাপনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল বিটিআরসি। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে এক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ‘এয়ারটেল’ ব্র্যান্ড নেমের আর যাতে প্রচার-প্রসার না হয়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বিটিআরসির ২৬৯তম কমিশন বৈঠকে।
সে সময় কমিশন বৈঠকে এয়ারটেল নামে কোনো প্যাকেজ অফার না করা, যেসব প্যাকেজ চালু আছে, তার মেয়াদ শেষ হলে তা আর এয়ারটেল নামে নবায়ন না করা, এয়ারটেলের নামে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার না করা এবং এয়ারটেলের হোল্ডিং বা ব্যানার বিজ্ঞাপন থাকলে তা দুই মাসের মধ্যে সরিয়ে ফেলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর আগেও নানা সময়ে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে রবি। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বরের আগে কোম্পানিটির অনুকূলে সংরক্ষিত শেয়ার হস্তান্তরের বিধিনিষেধ থাকলেও সে বছরের এপ্রিলে কোম্পানিটির বিনিয়োগ অংশীদার জাপানের এনটিটি ডোকোমো শেয়ার হস্তান্তরের কার্যক্রম শুরু করে দেয়। রবিতে থাকা ডোকোমোর অংশ ৬ দশমিক ৩ শতাংশ ভারতী এয়ারটেলের কাছে বিক্রয়ের জন্য শর্ত ভেঙে অনুমোদন দেয় বিটিআরসির তৎকালীন প্রশাসন। ডোকোমোর শেয়ার কিনে নেয়ার ফলে রবিতে ভারতী এয়ারটেলের শেয়ার দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ। অবশিষ্ট ৬৮ দশমিক ৭০ শতাংশের মালিকানা রবির কাছেই থাকে।
জানতে চাইলে রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এয়ারটেল" রবি আজিয়াটা লিমিটেডের একটি সাব-ব্র্যান্ড। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদিত একীভূতকরণ নির্দেশনার মাধ্যমে, রবি আজিয়াটা লিমিটেড এয়ারটেল বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে এয়ারটেল ব্র্যান্ডসহ এর সমস্ত ট্রেডমার্ক, লোগো এবং মেধাস্বত্ব অধিকার (আইপিআর) অর্জন করেছে।’
তিনি বলেন, ‘এটি উল্লেখযোগ্য যে"ব্র্যান্ডের নাম কোম্পানির সত্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কোনো কোম্পানি সত্তা হিসেবে অস্তিত্ব না থাকলেও একটি ব্র্যান্ড তার নিজস্ব পরিচিতি ধরে রাখতে পারে, যা সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। একই কোম্পানির অধীনে একাধিক ব্র্যান্ড থাকা টেলিকম এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্য শিল্পে খুবই সাধারণ। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের অন্যান্য টেলিকম অপারেটরদের মধ্যেও এমন প্রক্রিয়া প্রচলিত রয়েছে।’
কোম্পানিটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে সাব-ব্র্যান্ড হিসেবে গ্রামীণফোনের স্কিটো, সিঙ্গাপুরে সিংটেলের গোমো, সিঙ্গাপুরের স্টারহাবের গিগা, চায়না টেলিকমের এম জোন, গো টোন, ইসি ওন, এন্ড এন্ড, মালয়েশিয়ার ম্যাক্সিসের হটলিংক, হংকং এইচ কে আইয়ের ক্লাব সিম, ফ্রান্সের অরেঞ্জের সোশ, সুইডেনের টেলি২-এর কমভিক এবং বেলজিয়ামের প্রক্সিমাসের স্টারলেট প্রতিষ্ঠিত। শুধু টেলিকম খাতে নয়, ভোগ্যপণ্য কোম্পানিগুলোও একই সাধারণ পণ্য বিভাগের জন্য আলাদা সাব-ব্র্যান্ড তৈরি করে থাকে, উদাহরণস্বরূপ, প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের টাইড এবং এরিয়েল, ইউনিলিভারের সার্ফ এবং ওএমও, কোলগেট-পামোলিভের কোলগেট টোটাল, কোলগেট ম্যাক্স ফ্রেশ এবং কোলগেট অপটিক হোয়াইট। নির্দিষ্ট গ্রাহকের সেবায় টেলিকম অপারেটররা আলাদা পরিষেবার মাধ্যমে ডিজিটাল জীবনযাত্রায় বৈচিত্র্য আনতে সাব-ব্র্যান্ড তৈরি করে এবং এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
রবির পক্ষ থেকে বেশকিছু কোম্পানির সাব-ব্র্যান্ডের উদাহরণ দেয়া হলেও এগুলো কোম্পানির নিজস্ব ও মৌলিক সাব-ব্র্যান্ড। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এগুলো একীভূতকরণের আওতায় পড়েনি। গ্রামীণফোন স্কিটো ব্র্যান্ডের যাত্রা হয় ২০১৭ সালে, সিঙ্গাপুরের সিংটেল গ্রুপের গোমো ব্র্যান্ড ২০১৯ সালে, স্টারহাবের ডিজিটাল মোবাইল সার্ভিস গিগা, ৬৩ লাখ ব্যবহারকারীর হটলিংক ব্র্যান্ড ১৯৯৯ সালে ম্যাক্সিসের হাত ধরে যাত্রা করে। সুইডেনের টেলিযোগাযোগ খাতে টেলিভারকেট কোম্পানির মনোপলি ব্যবসা ভেঙে এসেছিল কমভিক। এগুলোর কোনোটি অধিগ্রহণ বা একীভূতকরণের মাধ্যমে হয়নি।
টেলিকম অপারেটর রবি আজিয়াটা ও এয়ারটেলের একীভূতকরণে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়েছিল। ২০১৬ সালের ১৩ জুলাই দুই কোম্পানির একীভূতকরণে অনুমোদন দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর ১০ দিনের মধ্যে ২৪ জুলাই সারসংক্ষেপ প্রতিবেদন পাঠানো হয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ৩১ জুলাই চূড়ান্ত অনুমোদন দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময়ে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় নিজের অধীনেই রেখেছিলেন।
একীভূতকরণের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য মোট ৬০৭ কোটি টাকা নেয়ার সুপারিশ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে এয়ারটেলের ১ হাজার ৮০০ মেগাহার্টজ বা টুজি ব্যান্ডের ১৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গের জন্য মেগাহার্টজপ্রতি ৩৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা হিসাবে ৫০৭ কোটি টাকা ও একীভূতকরণ ফি হিসেবে ১০০ কোটি টাকা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এসব সুপারিশ অপরিবর্তিত রাখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
রবি-এয়ারটেলের কর্মীদের জন্য স্বেচ্ছা অবসর স্কিম (ভিআরএস) ও স্বেচ্ছা বিচ্ছেদ কার্যক্রম (ভিএসএস) নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণেও সুপারিশ করা হয়েছে। একীভূত হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যেই ভিআরএস ও ভিএসএসের আওতায় পুরো অর্থ পরিশোধের তথ্য অবশ্যই বিটিআরসিকে জানাতে বলা হয়। ভিআরএস ও ভিএসএস বাস্তবায়নে কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি হলে বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী একীভূত কোম্পানিকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া অপারেটর দুটি একীভূত হওয়ার তিন বছরের মধ্যে কোনো কর্মীকে চাকরিচ্যুত করতে হলে তার কারণসহ বিস্তারিত তথ্যও বিটিআরসিকে জানানোর শর্ত দেয়া হয়।
একীভূত হতে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিটিআরসির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করে রবি-এয়ারটেল। প্রস্তাব অনুযায়ী, একীভূত হওয়া কোম্পানি ‘রবি’ নামেই ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। অপারেটর দুটির হাতে থাকা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সব তরঙ্গ একীভূতকরণের ফলে তা হয় সব অপারেটরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সে সময় এয়ারটেলের কাছে ২০ মেগাহার্টজ ও রবির কাছে ১৯ দশমিক ৮০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ছিল। দুটি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত তরঙ্গের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৯ দশমিক ৮০ মেগাহার্টজ। সে সময় দেশের বৃহত্তম অপারেটর গ্রামীণফোনের কাছে সর্বোচ্চ ৩২ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ছিল।
জানতে চাইলে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একীভূতকরণের সময় এয়ারটেলের অনুমোদন থাকলে রবি সে ব্র্যান্ড নাম ব্যবহার করতে পারে। এর বাইরে আইনি কোনো বিষয় থাকলে সেটি আলাদা ব্যাপার। বিষয়টিকে তখন আইনিভাবেই সম্পন্ন করতে হবে। বাংলাদেশে বিভিন্ন টেলিকম প্রতিষ্ঠানের অধিগ্রহণ-একীভূতকরণের পর নাম পরিবর্তনের নজির রয়েছে। কারণ এসব ব্র্যান্ড তখন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিল। কিন্তু এখনো তরুণদের মধ্যে এয়ারটেল নামটির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সেজন্য হয়তো তারা আর পরিবর্তন করেনি।’
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়