বাংলাদেশে ভারত সীমান্তে সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোল। সীমান্তের ওপারে ভারতীয় অংশে পেট্রাপোল স্থলবন্দরকে বলা হয় এশিয়ার সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর। এ দুয়ে মিলে তৈরি করেছে এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর করিডোরটি। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে করিডোরটির দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটার ও পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা থেকে এ দূরত্বের পরিমাণ ৮০ কিলোমিটার।
পেট্রাপোল-বেনাপোল স্থলবন্দর করিডোর এখন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার স্থলবাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। দুই দেশের স্থলবাণিজ্যের ৩০ শতাংশই সম্পাদিত হচ্ছে এখান দিয়ে। শুধু স্থলবাণিজ্য নয়, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে মানুষ পারাপারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে পেট্রাপোল-বেনাপোল। প্রতি বছর এখান দিয়ে যাতায়াত করছে গড়ে ২২ লাখ যাত্রী। দুই দেশের মধ্যে যাত্রী পারাপার ও পণ্য পরিবহনকে সহজ করতে এখানে চালু রয়েছে সমন্বিত চেকপোস্ট।
করিডোরটি ব্যবহার করে সুতি কাপড়, যানবাহনের চেসিস, কাঁচা তুলা, ইস্পাত/লোহা, রাসায়নিক/রঞ্জক, সিনথেটিক কাপড়, মোটরসাইকেল ও হালকা যানবাহন, শিশুখাদ্য, খাদ্যশস্য নানা ধরনের পণ্য আমদানি করছে বাংলাদেশ। বিপরীতে রফতানি হচ্ছে তৈরি পোশাক, তুলা, ব্রিফকেস, ব্যাগ, পাটের সুতা, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের মতো পণ্য।
কিছুদিন আগেই পেট্রাপোল স্থলবন্দর এলাকা সফরে যান দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সফরে তিনি স্থলবন্দরের একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ওই সময় পেট্রাপোলে একটি কার্গো গেট উদ্বোধন করার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতীয় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ শুধু দেশটির অর্থনীতিকেই শক্তিশালী করছে না, একই সঙ্গে তা সীমান্তে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করছে। আমাদের নীতিমালা পরিষ্কার। আমরা চাই সীমান্ত এলাকায় শক্তিশালী অবকাঠামো ও কানেক্টিভিটি গড়ে উঠুক, যাতে করে তা ব্যবসা ও বাণিজ্য বাড়িয়ে তুলতে পারে।’
বাংলাদেশের বেনাপোল ও ভারতের পেট্রাপোল—সীমান্তের দুই পারেই বাণিজ্য অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে বিশ্বব্যাংক। বেনাপোল-পেট্রাপোল ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্য খাতে ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে উঠতে পারে বলেও বিভিন্ন সময়ে সংস্থাটির বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
ভারতীয় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের (এলপিএআই) তথ্য অনুযায়ী, পেট্রাপোল দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের আকার প্রতি বছরই বাড়ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর এ স্থলবন্দরে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৭৯৯ কোটি রুপি। ২০২০-২১ অর্থবছর করোনা মহামারীর কারণে বাণিজ্যের পরিমাণ কমলেও অন্য বছরগুলোয় বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর ২১ হাজার ৩৮০ কোটি রুপি, ২০১৯-২০ অর্থবছর ২০ হাজার ৬০৫ কোটি রুপি, ২০২০-২১ অর্থবছর ১৫ হাজার ৭৭১ কোটি রুপি, ২০২১-২২ অর্থবছর ২৯ হাজার ৪০৬ কোটি রুপির বাণিজ্য হয়েছে পেট্রাপোল দিয়ে। আর চলতি অর্থবছর এখন পর্যন্ত পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে হওয়া বাণিজ্যের পরিমাণ ১৯ হাজার ৬৩১ কোটি রুপি।
ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমানের ভাষ্য হলো ‘দেশে সরকার অনুমোদিত মোট ২৪টি স্থলবন্দর আছে। এর মধ্যে মাত্র ১২টি বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি হয়। অন্যান্য বন্দর দিয়ে ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যের আগ্রহ কম। বেনাপোল নিয়েই ব্যবসায়ীদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি।’
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছর এখান দিয়ে আমদানি হয়েছিল ১৯ দশমিক ৮৮ লাখ টন পণ্য। বিপরীতে রফতানি হওয়া পণ্যের পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৫৩ লাখ টন। একইভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছর ২১ দশমিক ৮১ লাখ টন পণ্য আমদানি ও ৪ দশমিক শূন্য ১ লাখ টন পণ্য রফতানি, ২০১৯-২০ অর্থবছর ২০ দশমিক ৩৮ লাখ টন পণ্য আমদানি ও ৩ দশমিক ১৭ লাখ টন পণ্য রফতানি, ২০২০-২১ অর্থবছর ২৭ দশমিক ৭৮ লাখ টন পণ্য আমদানি ও ২ দশমিক ৯৭ লাখ টন পণ্য রফতানি হয়েছে। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছর এ বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে ২২ দশমিক ১৩ লাখ টন পণ্য। আর রফতানি হয়েছে ৪ দশমিক ১৯ লাখ টন পণ্য।
মূলত পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার সঙ্গে স্বল্প দূরত্বই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে পেট্রাপোল-বেনাপোল স্থলবন্দর করিডোরের ব্যবহার বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা। বেনাপোল আমদানি-রফতানি সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক বলেন, ‘বেনাপোল বন্দর থেকে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক শহর কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এ পথে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি ব্যবসায়ীদের।’
আমদানি-রফতানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেনাপোল স্থলবন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণও বেড়েছে। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২৬ দশমিক ১৫ লাখ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছর ২৯ দশমিক ১২ লাখ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছর ৩২ দশমিক ১৩ লাখ টন, ২০২০-২১ অর্থবছর ৩৩ দশমিক ১৭ লাখ টন ও ২০২১-২২ অর্থবছর বেনাপোল স্থলবন্দরে ৩৯ দশমিক ৯৩ লাখ টন পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়েছে।
তবে বেনাপোল স্থলবন্দরে এখনো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি অভিযোগ তুলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু অবকাঠামোগত সংকটের কারণেই বেনাপোল স্থলবন্দর বাণিজ্যের পরিমাণ নেমে এসেছে কাঙ্ক্ষিতের অর্ধেকে। মাঝেমধ্যে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি-হয়রানির মধ্য দিয়েও যেতে হয়। বন্দরের সক্ষমতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলে অভিমত দিয়ে বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামসুর রহমান বলেন, ‘বেনাপোল বন্দরের ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৪৫ হাজার টন পণ্যের। স্বাভাবিক সময়ে বন্দরে দুই লাখ টন আমদানি পণ্য নিয়ে ভারতীয় ট্রাক খালাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। এসব ট্রাকে শিল্প-কারখানার কাঁচামাল ও সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের নির্মাণাধীন যন্ত্রপাতি রয়েছে। জায়গার অভাবে এসব পণ্য খালাস করা সম্ভব হয় না। এতে প্রতিদিন ট্রাকপ্রতি ৩ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের।’
বন্দরে ভারী পণ্য ওঠানামায় ব্যবহূত ক্রেন ও ফর্কলিফট বেশির ভাগ সময় অচল হয়ে পড়ে থাকায় পণ্য খালাসে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমানও।
অভিযোগ রয়েছে সীমান্তের ওপারের পেট্রাপোল বন্দরের ব্যবসায়ীদেরও। পেট্রাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, ‘বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমরা স্বাভাবিক সময়ের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য রফতানি করতে পারি না। কারণ বেনাপোল বন্দরে সব সময় জায়গা সংকট থাকে। এ সমস্যার দ্রুত নিরসন প্রয়োজন।’
বেনাপোলের শুল্ক কর্মকর্তারাও বলছেন, অবকাঠামোগত সংকটে এখান থেকে লক্ষ্যমাফিক রাজস্ব আহরণ করা যাচ্ছে না। তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছর বেনাপোলে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ২৪৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, সেখানে আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ১৪৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৯৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে বেনাপোল কাস্টম হাউজের যুগ্ম কমিশনার আবদুর রশিদের বক্তব্য হলো ‘বন্দরে পণ্যাগার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা চাহিদামতো পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। বেনাপোল বন্দরে ঢোকার অপেক্ষায় সীমান্তে পেট্রাপোল অংশে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকছে এক থেকে দেড় মাস ধরে।’
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেনাপোলের উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সিসি ক্যামেরা, অ্যাকসেস কন্ট্রোল সিস্টেম ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হচ্ছে। কার্গো টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ২৮৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সম্প্রতি একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। এর বাইরে ১৬ দশমিক ৪৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে রাসায়নিক শেড স্থানান্তরের কাজ চলমান রয়েছে। এসব কাজ বাস্তবায়নের পর বেনাপোল স্থলবন্দরের কার্যক্রম আরো গতিশীল হয়ে বাণিজ্যের আকার আরো বাড়বে।
বেনাপোল স্থলবন্দরের উপপরিচালক (ট্রাফিক) আবদুল জলিল বলেন, ‘এরই মধ্যে বন্দরে জায়গা অধিগ্রহণ করে নতুন পণ্যাগার তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। আরো জায়গা অধিগ্রহণের কাজ চলছে। তবে এসব কাজ শেষ হতে আরো আড়াই বছরের মতো সময় লাগবে। ওই সময় বেনাপোল বন্দরের সক্ষমতা আরো অনেক বাড়বে। ক্রেন, ফর্কলিফটের সমস্যা সমাধানে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।’
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়