বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের পর তাদের নিম্ন মজুরি পাওয়ার বিষয়টি সবার নজরে এসেছে। অবশেষে সরকারের হস্তক্ষেপে দৈনিক মজুরি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র চা শ্রমিকরাই নয়, এমন নিম্ন মজুরি পাচ্ছেন আরো অনেক খাতের শ্রমিক।
জ্বালানি ও ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের চড়া দাম, মূল্যস্ফীতির চাপ নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরো কঠিন করে তুলেছে। কোনো কোনো খাতের মজুরি গত কয়েক বছরে পুনঃনির্ধারণ করা হলেও অনেকগুলো খাতের মজুরির কোনো পরিবর্তন হয়নি। আবার সরকার নির্ধারিত মজুরির থেকেও কম দেয়ার অভিযোগ রয়েছে কোনো কোনো খাতে।
বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি
বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশা খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে সরকারের একটি বিশেষ বোর্ড রয়েছে। এই বোর্ডের কাজ হলো নিয়মিতভাবে মজুরি পর্যালোচনা করে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দেয়া। কিন্তু তৈরি পোশাকের মতো খাতে কিছুটা নিয়মিতভাবে মজুরি নির্ধারণ করা হলেও অন্যসব খাতের শ্রমিকদের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. সেলিনা আক্তার বলেন, ‘আমি কিছুদিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। এখন পুরো বিষয়টি যাচাই করে দেখবো। তবে কোনো সেক্টরে যদি মজুরি সময়োপযোগী না করা হয়, নিশ্চয়ই আমরা ব্যবস্থা নেবো।’
শ্রম সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ছয় কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে, যারা বিভিন্ন খাতে কাজ করেন। বাংলাদেশের সরকার ৪২টি খাত নির্ধারণ করে এ শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছে।
যদিও যে খাতে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করে, সেই কৃষি খাতের ক্ষেত্রে আলাদা কোনো মজুরি নেই। বাজারের চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে সেখানে মজুরি নির্ধারিত হয়।
বাংলাদেশের কোন খাতের শ্রমিকরা কেমন মজুরি পান?
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের গেজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একটি খাত থেকে আরেকটি খাতের মজুরির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। কোনো কোনো খাতের মজুরি মাত্র তিন হাজার টাকা, আবার কোনো কোনো খাতের মজুরি ১৬ হাজার টাকার বেশি।
যেমন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে আট হাজার টাকা। যার মধ্যে বেসিক হবে চার হাজার এক শ’ টাকা, বাড়ি ভাড়া দু’হাজার ৫০ টাকা ও অন্য খরচ এক হাজার ৮৫০ টাকা।
বিদেশী ক্রেতাদের চাপ, সরকারি নজরদারি ও শক্তিশালী শ্রম সংগঠন থাকায় এই খাতে মজুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু অন্য খাতে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে সেটি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
তার বাইরে রাবার শিল্প, পাটকল, বিড়ি, ম্যাচ শিল্প, জুট প্রেস, সিনেমা হল, হোসিয়ারি, কোল্ড স্টোরেজ, পেট্রোল পাম্প, আয়ুর্বেদিক কারখানা, আয়রন ফাউন্ড্রি ওয়েল মিলস অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, লবণ শিল্প, ইত্যাদি খাতের মজুরি সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয়েছিল বহু বছর আগে।
যেমন- কোল্ড স্টোরেজ ও ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প খাতের শ্রমিকদের সর্বশেষ মজুরি নির্ধারিত হয়েছিল ২০১২ সালে, ম্যাচ শিল্পের ২০১৩ সালে আর বিড়ি শিল্পের ২০১৬ সালে।
আবার পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি বহু বছর আগে নির্ধারণ করা হলেও পরে আর সমন্বয় করা হয়নি। তবে এই খাতে শ্রমিকরা এখন আট থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসে আয় করেন বলে জানা গেছে।
বাজারে মূল্যস্ফীতির সাথে মিল রেখে সেগুলো পরে আর সমন্বয় করা হয়নি। তবে কয়েকটি খাতের মজুরি পুনঃনির্ধারণের কাজ চলছে বলে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কেন বিভিন্ন খাতের মজুরিতে এত পার্থক্য?
বিভিন্ন খাতের মজুরি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, খাত ভেদে নিম্নতম মজুরিতে অনেক পার্থক্য রয়েছে। যেমন- হোটেল ও রেস্তোরায় নিম্নতম মজুরি ৩৭১০ টাকা হলেও নির্মাণ ও কাঠ শিল্পে ১৬ হাজার টাকার বেশি।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক নাজমা ইয়ামসিন বলেন, ‘বিভিন্ন খাতে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা, ঝুঁকি ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে অনেক সময় মজুরির কমবেশি হয়। যেমন- একজন দক্ষ কাঠমিস্ত্রি মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত মজুরির চেয়েও বেশি আয় করতে পারেন। আবার অনেকে নির্ধারিত মজুরি কাঠামোর কমও নিতে বাধ্য হন।’
কোনো খাতের মজুরি নির্ধারণ করার পর তিন থেকে পাঁচ বছর পরপর সেটি পুর্নমূল্যায়ন করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু অনেক খাতের মজুরি বছরের পর বছর ধরে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
নাজমা ইয়াসমিন বলেন, ‘সাধারণত নতুন মজুরি নির্ধারিত হয় সরকার, মালিকপক্ষ আর ট্রেড ইউনিয়নের আলোচনার মাধ্যমে। অনেক সময় সরকার বা মালিক নিজে থেকে এটা করতে পারে, আবার শ্রমিকদের চাপেও হতে পারে। কিন্তু অনেক খাতে দেখা যায়, যেসব খাতের ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠন জোরালো নয়, তাদের মজুরির বিষয়টি ঠিকভাবে মনোযোগ পায় না।’
তিনি জানান, অনেক সময় নিজেদের অধিকার, সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরির বিষয়টি শ্রমিকদের জানা থাকে না। ফলে তারা মালিকদের সাথে দরকষাকষি বা অধিকার আদায় করে নিতে পারে না।
বাংলাদেশে প্রায় ছয় কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে বলে জানায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউ অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। এর প্রায় অর্ধেক অদক্ষ শ্রমিক।
যেভাবে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়
বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। আইনে বলা আছে, কিভাবে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন হবে, কিভাবে কাজ করবে, কী বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে ও কত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করবে, সবই সেখানে বলা হয়েছে।
তবে কোনো পেশার মজুরির ক্ষেত্রে নিম্নতম মজুরি বোর্ড নিজেরা উদ্যোগ নিতে পারে না। এ বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে তাদের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানোর পর মজুরি বোর্ড কাজ শুরু করে এবং তাদের পর্যালোচনা শেষে সুপারিশ প্রদান করে।
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর পর নিম্নতম মজুরি পুনঃর্বিবেচনা করার বিধান রয়েছে। ফলে কোনো কোনো খাতে যেমন পাঁচ বছর পরে পুনরায় পর্যালোচনা করা হয়, কোনো কোনো খাতে তিন বছর পরে হয়ে থাকে, আবার কোনো কোনো খাতে দীর্ঘসময় ধরে কোনো পর্যালোচনা হয় না।
সাধারণত শ্রমিকদের জীবনযাপনের ব্যয়, জীবনযাপনের মান, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা ও দ্রব্যের মূল্য, মূল্যস্ফীতি এগুলোর সাথে কাজের ধরণ অর্থাৎ সেই কাজে ঝুঁকি কতটা আছে ও মালিকপক্ষের কতটা সামর্থ্য আছে, সেগুলোও বিবেচনায় নিয়ে নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়