তৈমূর আলম খন্দকার। নারায়ণগঞ্জ তো বটেই, পুরো দেশের সময়ের আলোচিত চরিত্র। ২০১১ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের আগের রাতে দলের সিদ্ধান্তে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়ে অঝোর কান্নায় আলোচনার খাতাও খুলেছিলেন সেদিন।
এবারের নারায়ণগঞ্জ সিটির ভোটে ফের আলোচনায় সেই তৈমূর। ভোটের মাঠে 'হাতি' নিয়ে কৌশলে হাঁটছেন তিনি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এরই মধ্যে দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং জেলার আহ্বায়কের পদ খুইয়েছেন। তৈমূর আসলে কার প্রার্থী- সেটা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা, মতভেদ। মেয়র পদে লড়াইয়ে নামা তৈমূর আলম খন্দকারের পেছনে কারা, সেই অঙ্কের হিসাব মেলাতে পারছেন না অনেকেই।
তৈমূরকে বিএনপি বা স্বতন্ত্র নয়, ওসমান পরিবারের প্রার্থী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তারই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী। নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দ্বৈরথে রূপ না দিয়ে ওসমান পরিবারের সঙ্গে পুরোনো লড়াই হিসেবে দেখানোর কৌশল নিয়েছেন আইভী।
পাল্টা কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি শব্দও খরচ না করে ব্যক্তি আইভীর মেয়র হিসেবে ব্যর্থতার ছবি ভোটারদের সামনে তুলে ধরেছেন কৌশলী তৈমূর। পৌর চেয়ারম্যান ও সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে আইভী টানা ১৯ বছর ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার যে হাওয়া তৈরি হয়েছে বলে তৈমূর দাবি করছেন, তাতে ভর করে জিততে চান তিনি। ভোটের লড়াইকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির যুদ্ধে রূপ না দেওয়ারও কৌশল নিয়েছেন তৈমূর। তাই একবারও নিজেকে বিএনপির প্রার্থী বলছেন না। আবার নানা অভিযোগ থাকা ওসমান পরিবারের প্রার্থী হিসেবে তাকে চিহ্নিত করতে আইভীর যে প্রচেষ্টা, সেটিকেও পত্রপাঠ খারিজ করছেন।
গতকাল রোববার নারায়ণগঞ্জ মহানগর এলাকা ঘুরে দু'পক্ষের ভোটের এসব কৌশল জানা গেছে নেতা ও ভোটারদের জবানিতে।
স্থানীয় বিএনপির বড় অংশ পাশে থাকলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তৈমূরের প্রার্থিতা ও নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের বিষয়ে নীরব রয়েছে। আবার স্থানীয় বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলোও তার পাশে নেই।
বিএনপি নেতাদের পাশে নিয়ে গতকাল বিকেলে নগরীর মাসদাইর এলাকার বাসভবনে মতবিনিময়ে মেয়র প্রার্থী তৈমূর আট পৃষ্ঠার যে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান, তাতে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার নাম মাত্র একবার এলেও ঘুরেফিরে ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা ও স্মৃতি। দাবি করলেন, প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালেই বলেছিলেন- তৈমূর বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী। আইভী লক্ষাধিক ভোটে জিতবেন- প্রধানমন্ত্রীর বরাতে যে খবর স্থানীয় সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, তা নাকচ করে তৈমূর বলেছেন, 'বিশ্বাস করতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কথা বলেননি। তার নামে মিথ্যাচার হচ্ছে।'
নিজেকে আবারও জনতার প্রার্থী ঘোষণা করে তৈমূর দাবি করেন, ওসমান পরিবারের দুই এমপি শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের হয়ে নির্বাচনে নামার প্রয়োজন অন্তত তার নেই। তিনি শামীম ওসমানের পায়ে হাঁটেন না। আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর সমালোচনায় মুখর হলেও সরকার, জাতীয় রাজনীতি সম্পর্কে একটি শব্দও খরচা করেননি তৈমূর। 'দুই নেত্রী দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন'- বছর আটেক আগে আইভী এমন কথা বলেছেন দাবি করে সেই বক্তব্যের কঠোর সমালোচনাও করেন।
মতবিনিময়ের পর সমকালের মুখোমুখি হন তৈমূর। বক্তব্যে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া কেন উহ্য- এ প্রশ্নে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। বলেন, 'এটা কেমন কথা! এগুলো নির্বাচন নষ্ট করার কথা।'
নিজেকে দলের প্রার্থী না বললেও মতবিনিময় সভায় তৈমূর দাবি করেন, বিএনপি তার পক্ষে একাট্টা। আওয়ামী লীগই বরং বিভক্ত। আইভীর পাশে নেই। স্থানীয় নেতারা পাশে থাকলেও কেন্দ্রীয় বিএনপির সমর্থন আছে কিনা- এ প্রশ্নে তৈমূর সমকালকে বলেন, 'রাজনীতিতে অনেক কৌশল থাকে।'
গত কয়েক বছর স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ জাতীয় রাজনীতির ইস্যুতে সরব থাকেন বিএনপি নেতারা। তবে নারায়ণগঞ্জের ভোটে জাতীয় রাজনীতি সম্পর্কে একেবারেই নীরব থেকে গৃহকর, জলাবদ্ধতা, যানজট ও সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারিতে সিন্ডিকেট নিয়ে সরব তৈমূর। এ প্রসঙ্গে তিনি সমকালকে বলেন, 'স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যুতে সীমাবদ্ধ থাকাই ভালো। মানুষও তাই চায়।'
স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ভোট সুষ্ঠু হবে কিনা- তা নিয়ে শুরু থেকেই উদ্বেগ জানাতে দেখা যায় বিএনপি নেতাদের। তবে তৈমূর বিশ্বাস করেন, একটি মেয়র পদের জন্য ভোট কারচুপিকে প্রশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবেন না।
নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া আইভীর কাজের সমালোচনায় মুখর হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মকাণ্ডে নীরব তৈমূর। তিনি সমকালকে বলেন, 'নারায়ণগঞ্জের বাইরে কী হচ্ছে, তা নিয়ে ভোটের সময় মাথা ঘামাতে চাইছি না। সারাদেশে কী হচ্ছে, তা মানুষ দেখছে।'
তৈমূরের মতবিনিময়ে থাকা এক বিএনপি নেতা সমকালকে জানান, পুরো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামলে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে পেরে ওঠা যাবে না। সরকার, পুলিশ, প্রশাসনকে প্রতিপক্ষ না বানানোর নীতিতে চলছেন তৈমূর। তাই শুধু আইভী ও তার ১৯ বছরের কার্যকালকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। এর সুফলও মিলছে। সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচনগুলোতে বিএনপি প্রার্থীরা আওয়ামী লীগ ও পুলিশের চাপে থাকলেও নারায়ণগঞ্জে একেবারে মুক্ত ও বাধাহীন ভোটের প্রচার চালাতে পারছেন। এখন পর্যন্ত তৈমূরের ভোটের প্রচারে একটিও হামলার ঘটনা ঘটেনি।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল হাতি প্রতীকের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট। তিনি জানান, মামলা ও অসুস্থতার কারণে বিএনপির অল্প কয়েকজন নেতা ভোটের প্রচারে নামতে পারেননি। বাকি সবাই সর্বাত্মকভাবে রয়েছেন। তৈমূর প্রার্থী হওয়ার পর বিএনপি তাকে জেলা আহ্বায়কের পদ থেকে প্রত্যাহার করেছে। ততক্ষণে তীর ছোড়া হয়ে গেছে। ছোড়া তীর তো ফেরানো যায় না। এ টি এম কামালের দাবি, দলের কেন্দ্রের তরফ থেকে তৈমূরের ভোটের প্রচারে অংশ নিতে নিষেধাজ্ঞা নেই।
আইভীর ভোটের প্রচারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, 'বিএনপির কাছ থেকে তালাক পেয়ে তৈমূর বন্যহাতিতে পরিণত হয়েছেন।'
আগের দিন শনিবার আইভী বলেছিলেন, 'তৈমূর গডফাদার শামীম ও সেলিম ওসমানের প্রার্থী। নিজ দলের এমপি শামীমকে গতকালও সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করেছেন তিনি। আইভী বলেছেন, শামীম ওসমানকে গডফাদার তিনি বলেননি, ৩০ বছর ধরেই গডফাদার শামীম ওসমানের উপাধি।
আসলেই ওসমান পরিবার তৈমূর সমর্থন দিচ্ছে কিনা- এ বিষয়ে শামীম ওসমানের বক্তব্য জানা যায়নি। তার বড় ভাই সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় পার্টির এমপি। জাতীয় পার্টির ইউপি চেয়ারম্যান ও নেতাদের তৈমূরের পক্ষে প্রকাশ্যে গণসংযোগে রয়েছেন। সেলিম ওসমান সমকালকে বলেন, কেউ জাতীয় পার্টির কাছে সমর্থন চায়নি। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের জোটে নেই, সংসদের প্রধান বিরোধী দল। জাতীয় পার্টির সমর্থন আওয়ামী লীগ চায়নি। আইভীও যোগাযোগ করেনি। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা কারও পক্ষে কাজ করলে তার কিছু করার নেই বলে জানান সেলিম ওসমান। তবে তৈমূরের দাবি, ভোট নিয়ে ওসমান পরিবারের সঙ্গে একটি কথাও হয়নি।
ওসমান পরিবারের সঙ্গে আইভী পরিবারের ফ্যাসাদ পাঁচ দশকের পুরোনো। ২০১১ সালে শামীম ও আইভী মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। সেবার তৈমূর ভোটের সাত ঘণ্টা আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। আওয়ামী লীগ সমর্থিত শামীমকে হারিয়ে মেয়র হন স্বতন্ত্র প্রার্থী আইভী।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্র জানিয়েছে, পুরোনো শত্রুতার কারণে আইভীর পাশে নেই শামীম ওসমানের অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। তাদের আইভীর পক্ষে ভোটে নামাতে শনিবার রাত থেকে পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আইভীর পক্ষে কাজ না করায় শনিবার বিলুপ্ত করা হয় মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি। এই সূত্রের ভাষ্য, ১৯ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকায় প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া এবং জাতীয় রাজনীতির সমীকরণের কারণে তৈমূরকে বিএনপির বা স্বতন্ত্র প্রার্থী নয়, ওসমান পরিবারের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে দেখাতে চাইছেন আইভী। ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে থাকা নানা অপকর্মের অভিযোগের দায় তৈমূরকে দিয়ে ভোটের বৈতরণি পার হতে চান তিনি।
ওসমান পরিবারের সমর্থনের গুঞ্জনকে নাকচ করে এ টি এম কামাল সমকালকে বলেছেন, আইভী নিজেই ২০১১ সালে বিএনপি-জামায়াতের ভোটে মেয়র হয়েছিলেন। এখন তাকে কাজের হিসাব দিতে হবে। নারায়ণগঞ্জের জন্য কিছু করেননি। ব্যর্থতা ঢাকতে তৈমূর আলমের নামের সঙ্গে ওসমান পরিবারকে জড়াচ্ছেন।
১৯৯৬ সালে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হয়েছিলেন নাগরিক ঐক্যের এখনকার নেতা এস এম আকরাম। ২০১১ সালের নির্বাচনে তিনি আইভীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ছিলেন। এবার তিনি তৈমূরের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান। এ ব্যাপারে তৈমূর বলেন, রাজনীতি যে পরিবর্তনশীল, এটা তার একটি উদাহরণ। বিএনপির সবাই হাতির সঙ্গে আছে। আরও অনেকেই আছে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়