২০২১-২২ অর্থবছরেও ব্যক্তি খাতের ভোগ ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের হার ছিল জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়েও বেশি। অন্যান্য অর্থবছরেও বেসরকারি ভোগ ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে মোটামুটি এ ধারাই দেখা গেছে। যদিও আগামী ৩০ জুন সমাপ্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। এ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির তুলনায় ব্যক্তি খাতের ভোগ ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হার অনেকটাই নিচে নেমেছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ সাময়িক হিসাবে উঠে এসেছে। জিডিপিতে বেসরকারি ভোগ ও বিনিয়োগ কমে আসার বিষয়টিকে অর্থনীতির জন্য ভীতিকর হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যক্তি খাতসংশ্লিষ্টরা। যদিও নীতিনির্ধারকদের প্রত্যাশা, এ পরিস্থিতি থেকে দ্রুতই বেরিয়ে আসতে সমর্থ হবে বাংলাদেশ।
স্থিরমূল্যে দেশের জিডিপির আকার (২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে) ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ১৪৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিবিএসের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। অর্থবছর শেষে জিডিপির সম্ভাব্য আকার হবে ৩২ লাখ ১৮ হাজার ৩ কোটি ৯ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের ভোগে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অর্থবছর শেষে দেশে মোট বেসরকারি ভোগের পরিমাণ হতে পারে ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৮৮০ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ব্যক্তি খাতের ভোগের আকার ছিল ২০ লাখ ২৩ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
এর সঙ্গে চলতি অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১ দশমিক ৭২ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ৭ লাখ ৮২ হাজার ৩৯ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছর শেষে এর আকার দাঁড়াতে পারে ৭ লাখ ৯৫ হাজার ৫৩৪ কোটি ২০ লাখ টাকায়। সব মিলিয়ে অর্থবছর শেষে ব্যক্তি খাতের মোট ভোগ ও বিনিয়োগের আকার দাঁড়াতে পারে ২৮ লাখ ৯২ হাজার ৪১৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ জিডিপির প্রায় ৯০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে ব্যক্তি খাতের ভোগ ও বিনিয়োগ।
২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে চলতি মূল্যে দেশের জিডিপির আকার হিসাব করা হয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। চলতি মূল্যেও হিসাব করে দেখা গেছে, ব্যক্তি খাতের ভোগ ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি জিডিপির তুলনায় বেশ নাজুক অবস্থানে রয়েছে।
মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে ব্যক্তি খাতের ভোগ ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির তুলনায় এতটা কমে যাওয়াকে অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও বেসরকারি খাতসংশ্লিষ্টরা। ব্যক্তি খাতের ভোগ ও বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধির হার নিম্নহার সত্ত্বেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপিত হার ৬ শতাংশের ওপরে ওঠার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা। তাদের ভাষ্যমতে, ভোগ কমার প্রধান কারণ হলো পণ্য বিক্রি কমে যাওয়া। ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতাকে চাপে ফেলেছে মূল্যস্ফীতি। এর ধারাবাহিকতায় হ্রাস পেয়েছে খুচরায় পণ্য বিক্রি তথা ভোগ। আবার বিনিয়োগকারীর হাতেও নতুন বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত তারল্য নেই। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাত এখন নাজুক অবস্থানে রয়েছে। অথচ শিল্প, বাণিজ্য, সেবাসহ সবকিছু বিবেচনায় মূলত ব্যক্তি খাতই দেশের অর্থনীতিতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় রয়েছে। বেসরকারি খাতের এ নাজুক পরিস্থিতি সার্বিক অর্থনীতির জন্য ভালো কিছুর ইঙ্গিতবাহী নয়।
বিষয়টি স্বীকার করছেন নীতিনির্ধারকরাও। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির বড় একটা চালিকাশক্তি হলো ব্যক্তি খাতের ভোগ ও ব্যয়। এগুলো কমেছে বলেই প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশে পৌঁছায়নি। এটা কম হতে পারে, কারণ আমাদেরকে মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। মূল্যস্ফীতিতে সবাইকেই ব্যয় সংকোচন করতে হয়েছে। কারণ মানুষ আগে যে দামে পণ্য কিনত, তা বহুলাংশে বেড়েছে। এ প্রবণতা খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে কৃষিজ-অকৃষিজ বা আমদানীকৃত সব পণ্যেই দেখা গেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে একটা অস্থির সময় আমরা কাটিয়েছি। যদিও মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ওপরে যায়নি। তবুও সাড়ে ৫ থেকে ৯ শতাংশে চলে যাওয়ার বিষয় দেখতে হবে। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ ভোগ ব্যয় করতে যেহেতু পারেনি, তাই এমনটাই হওয়ার কথা। আগামী অর্থবছরে এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসব বলে আশা করছি। কারণ মূল্যস্ফীতি কমে আসছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমছে। আমাদের দেশেও কমবে। আমাদের মূল্যস্ফীতি গত দুই মাসে কমেছে। আশা করি এখন ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে। এতে আগামীতে ভোগব্যয়ও বাড়বে। আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধিও এ বছরের চেয়ে বেশি হবে।’
বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ কমে আসায় দেশে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালসহ শিল্প খাতসংশ্লিষ্ট সবক’টি পণ্যের আমদানি কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ২৪৪ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের। যেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশে মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি খোলা হয়েছিল ৫৬৮ কোটি ১২ লাখ ডলারের। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৬ দশমিক ৯১ শতাংশ।
একই সময়ে শিল্পসংশ্লিষ্ট অন্য সব যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমেছে ৪৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির নতুন এলসি কমেছে ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। শিল্পের ইন্টারমিডিয়েট গুডস বা মধ্যবর্তী পণ্যের নতুন এলসিও কমেছে ৩১ শতাংশের বেশি।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি সায়ফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০২২-২৩ অর্থবছরে কভিড-পরবর্তী অবস্থা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধাবস্থা, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ সব দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। মহামারী-পরবর্তী অবস্থা, যুদ্ধাবস্থা এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’
ভোগব্যয় কমে যাওয়ায় বেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের শিল্প খাত। স্থানীয় বাজারে সব পণ্যেরই বিক্রি কমেছে বলে উদ্যোক্তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, দেশের বাজারে পণ্যভেদে বিক্রি কমার হার ২০-৩০ শতাংশ। ক্ষেত্রবিশেষে অনেক পণ্যের বিক্রি হ্রাস পেয়েছে আরো বেশি মাত্রায়। বিশেষ করে নির্মাণ ও আবাসন খাত মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পতিত হয়েছে। গৃহায়ন খাতের বিক্রয় পরিমাণ প্রায় ৬০ শতাংশ কমেছে। একই সঙ্গে উদ্যোক্তাদের নতুন প্রকল্প গ্রহণের হার কমেছে ৭৫ শতাংশ। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে এ খাতে প্রচণ্ড পরিমাণ তারল্য সংকটসহ মূলধনি ব্যয় জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রায় সব পণ্যের বিক্রি কমেছে। কারণ অভ্যন্তরীণ ভোগ কমেছে। আবার এর কারণ হলো মূল্যস্ফীতি, যার প্রভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। যেহেতু ক্রয়ক্ষমতা কমেছে সেজন্য মানুষ পণ্যও কিনছে কম। যে কারো কাছে প্রথমে খাওয়া-থাকা, তারপর অন্যান্য বিষয়। এগুলো সামলাতে মানুষের হিমশিম খেতে হচ্ছে। খুচরা সব খাতেরই বিক্রি কমে গেছে। দেখা যাচ্ছে ক্ষুদ্র-মাঝারি-কুটির শিল্পের উদ্যোক্তারা এখন নিজেদের সঞ্চয় ভেঙে চলছেন। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবসা থেকেও বেরিয়ে গেছেন। এমনকি আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বিক্রিও কমে গেছে। গোটা বিষয়টিই মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব না। স্থানীয় শিল্পে কনফেকশনারি, পোলট্রি থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যেরই ২০-৩০ শতাংশ করে বিক্রি কমেছে।’
ব্যক্তি খাত নাজুক অবস্থায় চলে যাওয়ার বিষয়টি টের পাচ্ছেন ব্যাংকাররাও। তাদের ভাষ্যমতে, একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপে ভোক্তার ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে উদ্যোক্তাদের হাতে বিনিয়োগের মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই। এ কারণেই শিল্প খাতের পণ্য ও যন্ত্রপাতি আমদানি কমে এসেছে। ভোক্তাদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে ভোগ ব্যয়ে রক্ষণশীল প্রবণতা।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়