রাজধানীর জুরাইনে রেলগেটে পুলিশ সার্জেন্ট ও থানা পুলিশের ওপর হামলাটি উপস্থিত লোকজনকে তাৎক্ষণিক উত্তেজিত করে করানো হয়েছে। নারীর গায়ে পুলিশ হাত দিয়েছে বলে খবর ছড়ানো হয়। এরপর লোকজন জড়ো হয়। শুরু হয় পুলিশের ওপর হামলা। এতে অংশ নেয় স্থানীয় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক ও হকাররা। যাদের ওই এলাকার সড়ক ও ফুটপাত থেকে বেশ কয়েকবার উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ নিয়ে পুলিশের ওপর তাদের আগে থেকে ক্ষোভ ছিল।
সার্জেন্টের বুকে থাকা বডি অন ক্যামেরাতে দেখা গেছে, উল্টোপথে আসার কারণে পুলিশ কাগজ চাওয়ার পর, মোটরসাইকেল চালক অসৌজন্যমূলক আচারণ শুরু করেন। তিনিও পুলিশের কাছে কাগজ চান। ওই সিগন্যালে পুলিশ মাস্তানি করে এবং চাঁদা তোলে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
পদ্ম সেতু চালু হওয়ার তারিখ নির্ধারণের পর থেকে ওই এলাকার সড়ক থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ফুটপাত থেকে হকারদের কয়েকবার উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল।
মঙ্গলবার (৭ জুন) বিকালে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মঙ্গলবার সকালে জুরাইন রেলগেট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহীর সঙ্গে পুলিশের বাকবিতাণ্ডা হওয়ার পর অলিগলিতে থাকা হকার ও রিকশা চালকরা বের হয়ে আসেন। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে হামলা চালান।
ঘটনার পর রেলগেট এলাকার স্থানীয় চায়ের দোকানে বসে মঙ্গলবার দুপুরের পর দিনমজুর শামীম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সকালে এক নারীর সঙ্গে পুলিশ খারাপ ব্যবহার করছে বলে আমাদের কাছে খবর আসে। এর কিছুক্ষণ পর সবাই একত্রে পুলিশকে ধাওয়া দেয়। এদের সবাই রিকশাচালক ও হকার।’
তিনি বলেন, ‘এক নারীর গায়ে পুলিশ হাত দিয়েছে বলে খবর পাই। তাকে পুলিশ চড় মারছে এমনও শুনেছি। তবে আমি এমন কিছু দেখিনি।’
রাসেল নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘যাত্রাবাড়ীর দিক দিয়ে জুরাইন রেলগেট দিয়ে উল্টো পথে আসায় পুলিশ সার্জেন্ট আলী হোসেন একজন মোটরসাইকেল চালকের গতিরোধ করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তার বাকবিতাণ্ডা হয়। একজন নারীও জোরে জোরে কথা বলছিলেন। তাদের নিয়ে পুলিশ পাশে যেতে চাইলে আরও বাকবিতাণ্ড হয়। হাতাহাতি হয়। লোকজন জড়ো হয়। ওই নারী মোবাইলে কথা বললে আরও লোকজন আসে। সবাই ক্ষিপ্ত হয়।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা গেছে, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শ্যামপুর থানার ঢাকা-মাওয়া ইনকামিং রোড জুরাইন রেলগেট সংলগ্ন জুরাইন নতুন রাস্তার মুখে ডিউটিরত ছিল সার্জেন্ট আলী হোসেন। তার সঙ্গে ওই এলাকার অন্যান্য ট্রাফিক সিগন্যালে ছিল এটিএসআই হাবীব, কনস্টেবল সিরাজ, কনস্টেবল মাহবুব ও কনস্টেবল আবেদ। এ সময় যাত্রাবাড়ীর দিক থেকে জুরাইন রেলগেট এলাকার দিকে ঢাকা মেট্রো ল ১৪-৮৪৭৯ নম্বরের মোটরসাইকেলটি আসে। সার্জেন্ট আলী হোসেন তার গতিরোধ করেন। মোটরসাইকেলে চালকের আসনে ছিলেন একজন পুরুষ, তার মাথায় হেলমেট ছিল। পেছনে অপর আরোহী নারী। তবে তার মাথায় হেলমেট ছিল না।
পরে পুলিশ জানতে পারে মোটরসাইকেল চালকের নাম সোহাকুল ইসলাম রনি (৩২) এবং পেছনে তার স্ত্রী ইয়াসিন জাহান নিশান ভূঁইয়া (৩০)। তাদের উল্টোপথে আসার কারণ জানতে চান সার্জেন্ট। এ সময় পুরুষ লোকটি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেন এবং নারী নিজেকে আইনজীবী পরিচয় দেন। ট্রাফিক সার্জেন্ট মোটরসাইকেলে কাগজপত্র চাইলে তারা দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং বাকবিতাণ্ডায় জড়ান। নানান যুক্তি দিতে থাকেন। এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এর মধ্যে ওই চালককে পুলিশ বক্সের ভেতরের দিকে নিতে চায় পুলিশ। তখন ওই নারী ফোন দিলে তার একজন ভাই আসেন। তাদের সবাইকে নিয়ে পুলিশের ওই এলাকার ট্রাফিক পরিদর্শক বিপ্লব ভৌমিক ভেতরে যেতে চান। এ সময় লোকজন আরও উত্তেজিত হয়।
পরে বেতার বার্তায় শ্যামপুর থানার বিষয়টি জানালে ওই এলাকার টহল টিম এসআই উৎপল দত্ত অপুর নেতৃত্ব উপস্থিত হয়।
তখন মানুষ উত্তেজিত হয়ে পুলিশের ওপর হামলা করে। জুরাইন পুলিশ বক্স ভাঙচুর করে। পুলিশকে এলোপাতাড়ি ইটপাটকেল মারে। এসআই সাকিবের নেতৃত্বে আরও একটি টিম অংশ নেয়। তবে হামলাকারীরা হামলা চালিয়ে যেতে থাকে। এতে সার্জেন্ট আলী হোসেন গুরুতর আহত হন। তার বাম হাত ও মাথা কেটে যায়। একই হামলায় কনস্টেবল সিরাজও আহত হন। পরে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় হাসপাতালে ভর্তি করেন। শ্যামপুর থানার এসআই উৎপল দত্তকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
পুলিশের একটি টিম মোটরসাইকেল চালক সোহাকুল ইসলাম রনি (৩২) ও তার শ্যালক ইয়াসির আরাফাত ভূঁইয়াকে (২৮) তুলে নিয়ে যায়। অতিরিক্ত পুলিশ বাড়িয়ে ওই এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হয়।
জুরাইন পুলিশ বক্সে গিয়ে দেখা গেছে, বক্সটির সব জানালার গ্লাস ভাঙা। ভেতরে আসবাবপত্র এলোমেলো। বক্সের নিচেই পুলিশের একটি মোটরসাইকেল (ঢাকা মেট্রো হ ১৪-৪১৭৫) ভাঙাচুরা অবস্থায় পড়ে আছে।
এদিকে এ ঘটনায় সোহাকুল ইসলাম রনি (৩২), তার স্ত্রী ইয়াসিন জাহান নিশান ভূঁইয়া (৩০) ও রনির শ্যালক ইয়াসির আরাফাত ভূঁইয়াকে (২৮) আসামি করে মামলা হয়েছে। এতে অজ্ঞাত আরও ৩৫০ থেকে ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সার্জেন্ট আলী হোসেন মামলার বাদী হয়েছেন। মামলা নম্বর ১১।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শ্যামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মফিজুল আলম। ওসি জানান, মামলায় বেআইনি সমাবেশ, ভাঙচুর, পুলিশকে হত্যাচেষ্টা, সরকারি কাজে বাধা দিতে আক্রমণ, সরকারি কাজে বাধা দিতে আঘাত, সরকারি কাজে বাধা দিতে গুরুতর আঘাত ও সরকারি সম্পতি ক্ষতি সাধনের অভিযোগ করা হয়েছে।
এ মামলায় নামীয় তিন আসামিকেই গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। বুধবার (৮ জুন) গ্রেফতার তিন জনকে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড আবেদন করা হবে।
মোটরসাইকেলের চালক সোহাগ উল ইসলাম রনি বার্তা বিচিত্রা নামক পত্রিকার সাংবাদিক বলে পুলিশের কাছে পরিচয় দিয়েছেন। তার স্ত্রী ইয়াসিন জাহান নিশান ভূঁইয়া ও রনির শ্যালক ইয়াসির আরাফাত ভূঁইয়া। তবে তাদের সম্পর্কের বিষয়ে পুলিশ এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি।
পুলিশ জানিয়েছে, এটি একটি ব্যস্ত সড়ক। এখানের ফুটপাত ও সড়ক থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা তুলে দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে এই সড়ক আরও ব্যস্ত হবে। রিকশাচালক ও হকারদের উত্তেজিত করে হামলাটি চালানো হয়েছে।
হামলার আগে ওই নারী সড়কে বসে ডাক চিৎকার করতে থাকেন। পুলিশের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ করেন। এমনকি তিনি তার স্বজনদের মোবাইল ফোনেও একই বিষয় জানায়। তখন তার ভাই ইয়াসিন আরাফাত ভূঁইয়া লোকজন নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। তাদের বাসা কদমতলীর রজ্জব আলী সরদার সড়কে।
সার্জেন্টের ‘বডি অন ক্যামেরায়’ যা দেখা গেলো
সার্জেন্ট আলী হোসেনের বুকে ‘বডি অন ক্যামেরা’ ছিল। ঘটনার সময় সেটি সচল ছিল। সেই ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সেটিতে দেখা যায়, মোটরসাইকেলটি উল্টো দিক দিয়ে আসার পর সার্জেন্ট আলী হোসেন ও একজন কনস্টেবল মোটরসাইকেল চালকের কাছে গাড়ির কাগজ চায়। তখন মোটরসাসাইকেল চালক উল্টো পুলিশের কাছে জানতে চায়, আপনার কাগজ কই? তখন পুলিশ উত্তর দেয়, ‘এইতো আমার গায়ে পোশাক।’
এরপর ভিডিওতে মোটরসাইকেল চালককে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারা প্রতিদিন এখানে মাস্তানি করেন, কিছু বলি না।’ পুলিশকে এ সময় বলতে শোনা যায়, ‘মাস্তানি করি মানে?’ তখন বডি ক্যামেরাটা নড়ে ওঠে, বোঝা যাচ্ছিল ধস্তাধস্তি। এ সময় মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে থাকা নারী সড়কে দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি পুলিশের উদ্দেশে বলে ওঠেন, ‘ভাইয়া, আমরা আইনজীবী।’ এভাবে ঝগড়ার শুরু।
এরপর পুলিশের শরীরে থাকা ক্যামেরাটি অন্ধকার হয়ে যায়, উচ্চস্বরে শব্দ শোনা যায়। এর কিছুক্ষণ পর এক নারীকে চিৎকার করতে শোনা যায়, ‘গায়ে হাত দিলো কেন?’ তখন পুলিশও বলতে থাকে, ‘সে হাত দিলো কেন।’ নারীর চিৎকারে সেখানে অনেক লোক জড়ো হয়। এরপর পুলিশের একজন এসে মোটরসাইকেল চালককে পুলিশ বক্সের ভেতরে নিয়ে যায়। তখন ওই নারীও তাদের পেছন পেছন যায়। এ সময় চিৎকার করেন তিনি। তিনি পুলিশ বক্সের বাইরে ছিলেন।
তিনি চিৎকার করতে থাকেন, ‘আমার স্বামীকে মারধর করছে, তাকে বাঁচান।’ এরপর আরও মানুষ জড়ো হয়। উত্তেজিত হয়ে পুলিশ বক্সে ইট মারতে শুরু করেন তারা। তারপর মোটরসাইকেল চালক ফেসবুকে লাইভ শুরু করেন। লাইভে পুলিশ বক্স ভাঙচুরের দৃশ্য দেখানো হয়। উত্তেজিত বিভিন্ন বয়সের মানুষ পুলিশ বক্সে ভাঙচুর চালায়। পুলিশকে মারধর করে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়