টাকার অবমূল্যায়নের সুবিধা নিতে পারছেন না রফতানিকারকরা

দেশে বর্তমানে ডলারের গড় বিনিময় হার ১০৮ টাকা ৪০ পয়সা। যদিও প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার এর চেয়ে কম—১০২ টাকা ১০ পয়সা। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে ডলারের বিনিময় হার অতিমূল্যায়িত অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও গত দুই বছরে দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। টাকার অবমূল্যায়নের ফলে রফতানিকারকদের সুবিধা পাওয়ার কথা থাকলেও তারা সেভাবে এর সুবিধা নিতে পারেননি। মূলত বিভিন্ন ধরনের ব্যয় বাড়ায় এর পুরোপুরি সুবিধা নেয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ধরে রাখার প্রবণতাটি অনেক দিনের। আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ নীতি অনুসরণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে দেশে ডলারের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার বা রিয়াল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেটের (রিয়ার) সঙ্গে মুদ্রাবাজারে ডলারের গড় বিনিময় হারে বরাবরই ব্যবধান দেখা গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে টাকার বিপরীতে ডলার ক্রমেই শক্তিশালী হলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে পরিস্থিতি একেবারেই বিপরীত। গোটা বিশ্বেই এখন ডলার অবমূল্যায়িত হচ্ছে। ইউরো, পাউন্ড, ইয়েনের বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার কমছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। 

টাকার মূল্যমান নিয়ন্ত্রণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন রফতানিকারকরা। এ কারণে বিভিন্ন সময় ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের দাবিও তুলেছেন তারা। কিন্তু গত দুই অর্থবছরে টাকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অবমূল্যায়ন হলেও তারা এর সুবিধা নিতে পারেননি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর বড় একটি কারণ হলো বাংলাদেশে এখন বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যবহৃত মুদ্রা ডলারের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার মুদ্রাবাজারের গড় বিনিময় হারের চেয়ে কম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে রফতানির বাজারে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাওয়া গেলেও আমদানিসহ সংশ্লিষ্ট পরিষেবার ব্যয়ও বেড়ে যায়। বাংলাদেশের রফতানি খাত কাঁচামালের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল। ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাওয়ার কথা থাকলেও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তা খুব একটা কাজে আসেনি রফতানিকারকদের।  

প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার বা রিয়ার হলো অন্যান্য মুদ্রা নিয়ে গঠিত কারেন্সি বাস্কেট বা সূচকের বিপরীতে কোনো মুদ্রার বিনিময় হারের ভারিত গড়। এক্ষেত্রে সাধারণত প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের কারেন্সি বাস্কেট বা সূচকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মুদ্রার বিনিময় হারের ভারিত গড়ের তুলনা করা হয়। মূলত বৃহৎ অর্থনীতির ১৫টি দেশের কারেন্সি বাস্কেট তৈরি করে ডলারের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার বা রিয়াল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (রিয়ার) নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জুন শেষে দেশে ডলারের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার ছিল ১০০ টাকা। একই সময়ে ডলারের গড় বিনিময় হার ছিল ৭৮ টাকা ৪০ পয়সা। ২০১৭ সালের জুনে প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার ১০২ টাকা ৪০ পয়সা এবং গড় বিনিময় হার ৮০ টাকা ৬০ পয়সায় দাঁড়ায়। এর পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের জুন শেষে এ হার ছিল যথাক্রমে ১০০ টাকা ৭০ পয়সা ও ৮৩ টাকা ৭০ পয়সা। ২০১৯ সালের জুন শেষে দেশের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার ১০৫ টাকা ৭০ পয়সা এবং গড় বিনিময় হার ৮৪ টাকা ৫০ পয়সায় দাঁড়ায়। ২০২০ সালের জুন শেষে প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার ১১৩ টাকা এবং গড় বিনিময় হার হয় ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। ২০২১ সালের জুন শেষে এ হার ছিল যথাক্রমে ১১০ টাকা ৪০ পয়সা ও ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। গত বছরের জুন শেষে প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার দাঁড়ায় ১১১ টাকা ৩০ পয়সায়। এ সময়ে গড় বিনিময় হার ছিল ৯৩ টাকা ৫০ পয়সা। সর্বশেষ এ বছরের মার্চ শেষে ডলারের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ১০২ টাকা ১০ পয়সা। এ সময়ে গড় বিনিময় হার ছিল ১০৬ টাকা ৭০ পয়সা। এ বছরের জুন শেষে ডলারের গড় বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ১০৮ টাকা ৪০ পয়সায়।

দীর্ঘদিন ধরেই টাকার বিনিময় হারে নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানের সমালোচনা করে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। এক্ষেত্রে তাদের ভাষ্য ছিল, ডলারের বিপরীতে টাকার যে মান দেখানো হচ্ছিল, সেটি কৃত্রিম। অর্থনীতিকে শক্তিশালী দেখানোর পাশাপাশি আমদানিকারকদের সুবিধা দিতে টাকার মান বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব ছিল ধীরে ধীরে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করে দেয়া। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে সেটি করা হয়নি। দেশে হুন্ডির বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠার পেছনেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ভুল নীতির দায় সবচেয়ে বেশি।

এ বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঋণ অনুমোদনের সময় বাংলাদেশের আর্থিক পরিস্থিতির ওপর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও বিদ্যমান বিনিময় হার ও প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হারের মধ্যকার পার্থক্যের বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার গড়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে। উচ্চমূল্যস্ফীতির মধ্যেও ২০২১-২২ অর্থবছরে এটি ২ দশমিক ৪ শতাংশ এবং গত বছরের জুন-অক্টোবর সময়ে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে।  যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। গত বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যমান বিনিময় হার ও প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধান ২ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ১০ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে থাকবে বলে আইএমএফের কর্মকর্তারা মনে করছেন। এক্ষেত্রে তারা মাঝামাঝি অবস্থান নির্ধারণ করেছেন ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমরা কখনই সক্রিয় বিনিময় হার ব্যবহার করি না। এতে আমাদের রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রভাবিত হচ্ছে। আমদানি ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি বাড়বে—এমন শঙ্কা থেকে আমরা এটিকে নিয়ন্ত্রণ করছি। কিন্তু এর ফলে অন্য জায়গায় প্রভাব পড়ছে। বেশি সময় ধরে এটি অব্যাহত থাকলে আমাদের এক্সটার্নাল ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যায়। যেটি এখন দেখা যাচ্ছে।’

গত দুই বছরে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়া সত্ত্বেও রফতানি ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে এখনো সেভাবে এর প্রভাব দৃশ্যমান না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‌এর মানে হচ্ছে বাজারকে প্রভাবিত করার জন্য যে বিনিময় হার দরকার, সে পর্যায়ে এখনো যায়নি। এখন তো সরকার উভয় সংকটের মধ্যে রয়েছে। একদিকে ডেফার্ড পেমেন্ট বাড়ছে, অন্যদিকে রেমিট্যান্স কম আসছে। বিনিময় হারকে আরেকটু নমনীয় করে সুদহার বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতির মধ্যে আমি সমন্বয়ের অভাব দেখছি।’ 

দেশের পোশাক রফতানিকারকরা বলছেন, প্রচলিত স্বাভাবিক পদ্ধতি হলো জাহাজীকরণের পর রফতানিকারকের পণ্য যাবে। পেমেন্ট আসবে ডলারে। সে ডলারেই রফতানিকারকের ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্রের দায় পরিশোধ হবে। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সময়মতো ক্রেতার কাছ থেকে পেমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না। পণ্য রফতানির পর যখন নথিপত্র জমা দেয়া হয়, ব্যাংক সেটা পারচেজ করে বা কিনে নেয়। এক্ষেত্রে আগে ডলার রেট ছিল ৯৯ টাকা। এখন কিছুটা বেড়েছে। তবে ব্যাক টু ব্যাকের দায় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার কিনতে হচ্ছে ১০৯ টাকা করে। তাতে প্রতি ডলারে ৬ থেকে ৮ টাকার ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। এ ব্যবধানের কারণে ব্যাংকে প্রত্যেক রফতানিকারককেই ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো রফতানিকারকের ১৫ লাখ ডলারের ব্যাক টু ব্যাকের দায় পরিশোধ করতে গিয়ে যদি ৭ টাকা পার্থক্য হয় তাহলে প্রতি মাসে ক্ষতি হয় ১ কোটি টাকা, যা বছরের হিসাবে দাঁড়াচ্ছে ১২ কোটি টাকায়। সব মিলিয়ে বিনিময় হারের সুবিধা রফতানিকারকরা পাননি। 

বাংলাদেশের রফতানিকারকরা যে পরোক্ষভাবেও বিনিময় হারের সুবিধা নিতে পারছেন না, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষায়ও তা উঠে এসেছে। হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিউআইএমএর সর্বশেষ সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে গতকাল। বিশ্বের ২৫০টিরও বেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ওপর করা সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে ক্রেতাদের জনপ্রিয় ক্রয় গন্তব্য হিসেবে শীর্ষ তিন গন্তব্যের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। চতুর্থ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের আগে জনপ্রিয় গন্তব্য হিসেবে রয়েছে ভারত ও ভিয়েতনাম। 

গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, সমীক্ষার আওতায় থাকা ক্রেতাদের কাছে ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে চীনের পরে সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রয় গন্তব্য ছিল ভারত। ২৬ শতাংশ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ভারতের নামটি জনপ্রিয় বা বহুল ব্যবহৃত গন্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেছে।একই হারে জনপ্রিয় ক্রয় গন্তব্য হিসেবে উঠে এসেছে ভিয়েতনামের নাম। মাত্র ১৭ শতাংশ ক্রেতা জনপ্রিয় গন্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের নাম।
এই বিভাগের আরও খবর
এস আলমের শেয়ার বিক্রি করে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে: ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান

এস আলমের শেয়ার বিক্রি করে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে: ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান

প্রথমআলো
ব্যাংকের ওপর আস্থা কমায় টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনছে মানুষ

ব্যাংকের ওপর আস্থা কমায় টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনছে মানুষ

কালের কণ্ঠ
বিদ্যুৎ নিয়ে আদানির সাথে হওয়া চুক্তি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট

বিদ্যুৎ নিয়ে আদানির সাথে হওয়া চুক্তি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট

নয়া দিগন্ত
প্রাইম ব্যাংক ও সেবা ডট এক্সওয়াইজেডের মধ্যে চুক্তি সই

প্রাইম ব্যাংক ও সেবা ডট এক্সওয়াইজেডের মধ্যে চুক্তি সই

বাংলা ট্রিবিউন
ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু

ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু

বাংলা ট্রিবিউন
ভারতে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম, কেজি উঠেছে ৭০–৮০ রুপিতে

ভারতে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম, কেজি উঠেছে ৭০–৮০ রুপিতে

প্রথমআলো
ট্রেন্ডিং
  • সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে 'বস্তায় বস্তায় ঘুষ' নেওয়ার অভিযোগ: দুদকের অনুসন্ধান শুরু

  • ভালোবাসা দিবসে পরী মনির ‘বুকিং’

  • নির্বাচনের আগে পাকিস্তানে জোড়া বিস্ফোরণে নিহত ২৮

  • ভিসা পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে নিলো যে দেশ

  • শন্তিপূর্ণভাবে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি: প্রধানমন্ত্রী

  • ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের পারমাণবিক অস্ত্র বাড়বে তিন গুণ

  • তানজানিয়ায় প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৯

  • ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার বেশি থাকলে বেশি কর

  • কাতার বিশ্বকাপে ফিরছে জিদানের সেই ভাস্কর্য

  • ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞায় তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া