দেশের জ্বালানি খাতে কয়েক বছর ধরে গ্যাস সরবরাহ সংকট চলছে। শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকদের ওপরও পড়ছে এর প্রভাব। গ্যাস সংকট উত্তরণে সরকার নানা পরিকল্পনা হাতে নিলেও বিনিয়োগ হয়েছে মূলত সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায়। বৃহৎ আকারে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে বিনিয়োগের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে সামান্যই। গ্যাস নিয়ে বিদ্যমান এ সংকটকে প্রাথমিক জ্বালানিতে বিনিয়োগের পরিকল্পনায় বড় ভুল হিসেবে দেখছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, দেশে গ্যাস সংকটের এ সমস্যা মূলত গ্যাসের চাহিদার সঙ্গে সরবরাহ ব্যবস্থার পথ তৈরি করতে না পারা। এলএনজি আমদানি দিয়ে জ্বালানি চাহিদা পূরণের পথ বেছে নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমও দীর্ঘদিন ধরে ঢিমে তালে চলছে। এক্ষেত্রে দেশীয় কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতাকেও কাজে লাগানো যায়নি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে বিদ্যমান গ্যাস সংকটের প্রধানতম কারণ দীর্ঘদিন গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম অকার্যকর থাকা, হাতে পর্যাপ্ত ডাটা থাকা সত্ত্বেও সেগুলো ব্যবহার না করে আমদানিনির্ভর এলএনজিকে গুরুত্ব দেয়া। অথচ জ্বালানিপণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে কখনই স্থিতিশীল নয়। ফলে জ্বালানি পরিকল্পনায় যে সংকট তৈরি হবে তা সহজেই অনুমেয়।
দেশে বর্তমানে ৪৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। তবে পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস উৎপাদনচিত্রে দেখা গেছে, জাতীয় গ্রিডে ২৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। সরবরাহ সংকটের অবশিষ্ট অংশ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হচ্ছে।
তবে দেশের জ্বালানি চাহিদার কথা মাথায় রেখে গ্যাস খাতের উন্নয়নের অংশ হিসেবে ২০০৯ সালে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) গঠন করে সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে এ তহবিল থেকে বিনিয়োগ করার কথা। তবে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এ তহবিল থেকে অর্থ ব্যবহার করা হলেও অনুসন্ধান ও উত্তোলনে খুব বেশি সফলতা আসেনি।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে রিগ ও কম্প্রেসর কেনা এবং তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানসহ ৩৩টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে। যেখানে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। এছাড়া আরো অন্তত ১০টি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। এজন্য আরো অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। কিন্তু গ্রাহকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পরও গ্যাস খাতে খুব বেশি সাফল্য আসেনি।
দেশের জ্বালানি খাতে গুরুত্ব বিবেচনায় শুরুতেই গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে থাকা বিদ্যমান গ্যাসকূপগুলোর উন্নয়ন করা প্রয়োজন ছিল। তবে দেখা গেছে, গত এক দশকে বৃহৎ আকারে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া যায়নি। দেশে অনুসন্ধান কার্যক্রমে যুক্ত করা যায়নি বিদেশী কোনো বহুজাতিক কোম্পানিকেও।
এর বাইরে আমদানিনির্ভর জ্বালানি পরিকল্পনা করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের উন্নয়ন করা হয়েছে। অথচ এসব বিতরণ লাইনে অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও গ্যাস সংকটের কারণে তা চালু করা যায়নি।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ২০২০-২১ অর্থবছরে এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, দেশে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় অন্তত ৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এসব বিনিয়োগ মূলত হয়েছে পাইপলাইন নির্মাণে।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন সমান্তরাল পাইপলাইন নির্মাণে ২ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এলএনজি সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণে বিনিয়োগ করা হয়েছে ১ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। আনোয়ারা থেকে ফৌজদারহাট গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনে ৭৩৯ কোটি টাকা এবং দেশের উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য বগুড়া থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণে ১ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া আরো বেশ কয়েকটি সঞ্চালন প্রকল্পে ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
অন্যদিকে দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত একমাত্র রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স খুব বেশি কূপ অনুসন্ধান করতে পারেনি। দেশে গ্যাস খাতের এ অবস্থা তৈরি হওয়ার পেছনে বাণিজ্য ও সিন্ডিকেট গড়ে তোলার কথা জানিয়েছেন জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে মূলত দেশের জ্বালানি খাতকে একটি সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে।
শুধু এলএনজির আন্তর্জাতিক বাজারে দরবৃদ্ধির প্রভাবেই দেশে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা এমন মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলিত গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে অনুসন্ধান কার্যক্রমের অগ্রগতিও যৎসামান্য। সমস্যা মোকাবেলায় জ্বালানি বিভাগ নানামুখী পরিকল্পনা নিলেও তা কাজে আসছে না। উল্টো নির্ভরতা বাড়ছে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানামুখী পরিকল্পনা করা হলেও শুরুতেই গ্যাসের উৎস ও সংস্থান নিশ্চিত না করায় এমন সংকট তৈরি হয়েছে। এখন পর্যন্ত জ্বালানির প্রাপ্যতা নিশ্চিতে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। জ্বালানি সংস্থানের ক্ষেত্রে আমদানিতেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে স্থানীয় উৎসগুলোও এখনো এক প্রকার অকেজো। জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা প্রাধান্য পাওয়ায় দেশের গোটা শিল্প অবকাঠামোই এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
২০১৪ সাল থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন নসরুল হামিদ। এ সময়ে বিদ্যুৎ খাতে সাফল্য এলেও জ্বালানি খাত নিয়ে নানা ধরনের সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা, চাহিদা ও জোগান নিয়ে ২০১৭ সালে গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। মূলত এ পরিকল্পনা থেকে দেশের গ্যাস খাতের উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয়। তবে সেই পরিকল্পনার সঙ্গে দৃশ্যমান কোনো বাস্তবতা দেখা যায়নি।
গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনার বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, মাস্টারপ্ল্যানগুলো কখনই সঠিকভাবে ফলো করা হয় না। সেটা বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাসের ক্ষেত্রে হোক। মাস্টারপ্ল্যানগুলোয় যে ধরনের পরিকল্পনা থাকে, সেগুলো যে সারাক্ষণ মনিটরিং করব, তা আমরা করি না। ফলে দেখা যায়, একটা পর্যায়ে গিয়ে আমাদের নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
বঙ্গোপসাগরের গভীর-অগভীর অংশে ব্লকগুলোয় দুই দশক ধরে কোনো ধরনের অনুসন্ধান কার্যক্রম নেই বললেই চলে। প্রসঙ্গত, গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বঙ্গোপসাগরের অফশোর ও অনশোরে (গভীর ও অগভীর) অংশকে মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে গভীর সমুদ্রে ১৫টি ও অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক।
তবে গত বছর সিলেটের জকিগঞ্জে নতুন একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে বাপেক্স। সিলেট-৯ নম্বর কূপ খনন করে ১০৩ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার হয়েছে। এছাড়া শরীয়তপুরের নড়িয়ায় কূপ খনন করছে সংস্থাটি, যেখানে বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ৯৫ কোটি টাকা। এর বাইরে বেশ কয়েকটি কূপে ওয়ার্কওভারের কাজ করছে বাপেক্স।
এছাড়া বাপেক্স ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যেখানে ছয়টি অনুসন্ধান কূপ ও পাঁচটি উন্নয়ন কূপ খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে ১ হাজার ৫৯০ কিলোমিটার দুটি ভূতাত্ত্বিক এবং ১০ হাজার ৭২০ কিলোমিটার তিনটি দ্বিমাত্রিক জরিপ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়