বঙ্গোপসাগরে বড় সাফল্য ভারতের, এখনো বিনিয়োগের অপেক্ষায় বাংলাদেশ

গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চালিয়ে চলতি বছরের শুরুতে বড় সাফল্য পেয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে গভীর সমুদ্রে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বড় মজুদ আবিষ্কার করেছে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন লিমিটেড (ওএনজিসি)। 

সংস্থাটির ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে খনির দুটি ফেজের কাজ শেষ হয়েছে। তৃতীয় ফেজের কাজ চলমান। এটি শেষ হলে এখান থেকে প্রতিদিন ৪৫ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল এবং ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। সেক্ষেত্রে ভারতের দৈনিক মোট জ্বালানি তেল উত্তোলনে খনিটি অবদান রাখবে প্রায় ১১ শতাংশ। আর গোটা ভারতের মোট গ্যাস উত্তোলনে এ অবদান হবে ১৫ শতাংশ। 

বঙ্গোপসাগরের কৃষ্ণা-গোদাবরী বেসিনে ব্লকটি অবস্থিত। এটিকে এখন দেশটির সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ করা হচ্ছে কেজি-ডিডব্লিউএন-৯৮/২ ব্লক হিসেবে। ওএনজিসি জানিয়েছে, খনিটিতে কূপ খনন করতে গিয়ে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে ওএনজিসিকে। সেক্ষেত্রে গ্যাসের স্তরে পৌঁছতে পাইপ-ইন-পাইপ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়েছে সংস্থাটিকে। 

কৃষ্ণা-গোদাবরী বেসিনে জ্বালানি তেল আবিষ্কারের বিষয়টিকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছে ভারতীয় গণমাধ্যম। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এখান থেকে ঠিকঠাক উত্তোলন শুরু হলে দেশটির জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ বছরে সাশ্রয় হবে ১০ হাজার কোটি রুপিরও বেশি। 

তবে বঙ্গোপসাগরে জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে ভারতেরও আগে সাফল্যের দেখা পেয়েছিল মিয়ানমার। ২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হয় মিয়ানমারের। এরপর ২০১৩ সালে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে দেশটি। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত মিয়া ও শোয়ে কূপ থেকে এরই মধ্যে কয়েক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করেছে দেশটি। নিজস্ব চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এ গ্যাস তারা রফতানি করছে চীনেও।

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর ১৪ বছর পেরিয়েছে। ভারতের সঙ্গে এ সীমার নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ বছর আগে। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলনে কোনো সাফল্যেরই দেখা পায়নি বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, সীমানা নিষ্পত্তির পর গভীর সমুদ্রে জ্বালানি অনুসন্ধানে মনোযোগ বাড়িয়েছে মিয়ানমার ও ভারত। বিনিয়োগ করেছে বিভিন্ন পর্যায়ে। ফলে প্রয়োজনমতো বিদেশী বিনিয়োগও পেয়েছে। আর বাংলাদেশ সময়ক্ষেপণ করেছে আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতি বাস্তবায়নে। গভীর সাগরে নিজ সীমানায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিভিন্ন সময়ে বিদেশী বিনিয়োগের মৌখিক প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হলেও এ নিয়েও দেখা যায়নি কার্যকর কোনো উদ্যোগ। ফলে দেশের বিশাল সমুদ্র এলাকার জ্বালানি সম্ভার এখনো অনাবিষ্কৃতই থেকে গেছে।

দেশে গভীর ও অগভীর সমুদ্র সীমানায় ২৬টি ব্লক রয়েছে। এসব ব্লকের মধ্যে কয়েকটিতে গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এসব কোম্পানি নিজেদের বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এলেও পরে ব্লক ছেড়ে চলে গেছে। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে গ্যাসের সংকট বিরাজমান থাকলেও তা মোকাবেলায় আমদানিনির্ভরতাকেই বেছে নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।

যদিও জ্বালানি বিভাগ বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দেশে মোট ছয়টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। এ সময় ১৩২টি গ্যাসকূপ খনন করা হয়েছে। নতুন করে ৪৬টি গ্যাসকূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য ৩২ হাজার ৮৯০ কিলোমিটার টুডি সিসমিক সার্ভে এবং প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার সিসমিক সার্ভে করা হয়েছে। নতুন করে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার টুডি ও থ্রিডি সিসমিক সার্ভের কাজ চলমান রয়েছে।

দেশে গভীর ও অগভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে ‘বাংলাদেশ অফশোর মডেল প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট’ (পিএসসি) গত বছরে জুলাইয়ে অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। অনুমোদনের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত দরপত্র আহ্বান করা যায়নি। স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান কাজ চললেও সেটি এখনো ছোট পরিসরে। 

এদিকে, অব্যাহতভাবে দেশে আবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ ও উৎপাদন ক্রমেই কমে আসছে। এরই মধ্যে গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় শিল্প, আবাসিক ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ব্যাপকভাবে সংকটে পড়েছে। গ্যাসের অভাবে প্রতিনিয়ত ব্যাহত হচ্ছে শিল্পের উৎপাদন। বসিয়ে রাখা হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক অর্ধেক সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পরিস্থিতি মোকাবেলায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করেও সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে পেট্রোবাংলা তথা জ্বালানি বিভাগ।

গ্যাসের সরবরাহ সংকট মোকাবেলায় দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হয় ২০১৮ সালে। বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এর বাইরে স্পট মার্কেট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এলএনজি কিনে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে পেট্রোবাংলা।

জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে এরই মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে পেট্রোবাংলা। উচ্চমূল্যে পণ্যটি কিনতে গিয়ে তীব্রভাবে আর্থিক সংকটে পড়েছে সংস্থাটি। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে কখনো গ্যাস উন্নয়ন তহবিল আবার কখনো আন্তর্জাতিক ঋণদাতার দ্বারস্থ হতে হয়েছে সংস্থাটিকে।

দেশে গ্যাস খাত দেনার দায়ে জর্জরিত হওয়ার পেছনে স্থানীয় পর্যায়ে জ্বালানি অনুসন্ধানে বিমুখতা ও এলএনজির আমদানি বাড়ানোকে দায়ী করেছেন জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যে, অনুসন্ধান বিমুখতা হয়ে সহজ পথে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় গ্যাস খাতের সমস্যা নিরসন না হয়ে বরং বেড়েছে। যদিও এ বাবদ বিনিয়োগ করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দুটি দেশ। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হওয়ার পর মিয়ানমার গ্যাস পেয়েছে। গ্যাস রফতানি করছে। এখন গভীর সমুদ্রে ভারত বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল পাচ্ছে। সেই সঙ্গে গ্যাসও পেয়েছে। দুটি জায়গার মাঝখানে বাংলাদেশের যে জলসীমা রয়েছে, সেখানে গ্যাস পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা প্রবল। অথচ এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছি না। কারণ অনুসন্ধান কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বাংলাদেশে খুবই কম। সুতরাং আমাদের উচিত জ্বালানি সংকট মেটাতে আমাদের পদক্ষেপগুলো আরো ভালোভাবে নেয়া। সেটি করা গেলে গ্যাস নিয়ে এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে।’ 

দেশে গ্যাস অনুসন্ধান, জরিপ, কারিগরি সক্ষমতা ও অবকাঠামোয় বিনিয়োগের পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ছিল না। এর সব প্রকল্পই স্থলভাগে বিনিয়োগ। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পেট্রোবাংলার কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ রয়েছে ১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকার। মোট ৩০টি প্রকল্পের এসব বিনিয়োগের বেশির ভাগই কূপ সংস্কার, ওয়ার্কওভার, পাইপলাইন নির্মাণ ও জরিপ কার্যক্রম।

গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত শুধু প্রাথমিক পর্যায়ে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে করেছে পেট্রোবাংলা। ২০১৫ সালে এ কাজের জন্য নরওয়ের কোম্পানি টিজিএস ও ফ্রান্সের স্লামবার্জারের জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানিকে নির্বাচিত করা হয়। পরে অজ্ঞাত কারণে সে দরপত্র বাতিল হয়ে যায়। পুনরায় দরপত্রে ২০২০ সালের মার্চে একই কোম্পানিকে পুনরায় কাজ দেয়ার জন্য চুক্তি করে পেট্রোবাংলা। এরপর কোম্পানিটি দেশের বিশাল সমুদ্র এলাকার মধ্যে ৮-১০ কিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালায়। জরিপে জ্বালানি তেল ও গ্যাস পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও এখনো ফলাফল প্রকাশ হয়নি।

দেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ১৫টি ব্লকে অনুসন্ধান চালানোর জন্য পেট্রোবাংলাকে প্রস্তাব দিয়েছিল এক্সনমোবিল। এখনো সে প্রস্তাবের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আমাদের বড় বিনিয়োগ দরকার। সেই সঙ্গে প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও প্রয়োজন। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হওয়ার পর দুটির কোনোটিই করা যায়নি। বিদেশী তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দরকষাকষির মাধ্যমে গ্যাস অনুসন্ধানে বড় সুযোগ ছিল। কিন্তু এ ধরনের কাজে জোরালো কোনো উদ্যোগ কখনো দেখা যায়নি। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কনকো ফিলিপসের সঙ্গে একবার দরদাম শুরু হলেও চুক্তি করা যায়নি। সেটি করা গেলে হয়তো বড় কোনো সাফল্য পাওয়া যেত।’
এই বিভাগের আরও খবর
টোল আদায়ে দেড় হাজার কোটির মাইলফলকে পদ্মা সেতু

টোল আদায়ে দেড় হাজার কোটির মাইলফলকে পদ্মা সেতু

বাংলা ট্রিবিউন
টানা ৩ দিন ধরে কমছে সোনার দাম

টানা ৩ দিন ধরে কমছে সোনার দাম

দৈনিক ইত্তেফাক
বোতলের সয়াবিন তেলের লিটার ১৬৭, খোলা ১৪৭ টাকা

বোতলের সয়াবিন তেলের লিটার ১৬৭, খোলা ১৪৭ টাকা

দৈনিক ইত্তেফাক
মেট্রোরেলের টিকিটে ভ্যাট না বসানোর চেষ্টা চলছে

মেট্রোরেলের টিকিটে ভ্যাট না বসানোর চেষ্টা চলছে

প্রথমআলো
বাংলাদেশ থেকে সরাসরি তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারে ব্রাজিল

বাংলাদেশ থেকে সরাসরি তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারে ব্রাজিল

বিডি প্রতিদিন
ভারতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের রেকর্ড

ভারতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের রেকর্ড

বিডি প্রতিদিন
ট্রেন্ডিং
  • ভালোবাসা দিবসে পরী মনির ‘বুকিং’

  • নির্বাচনের আগে পাকিস্তানে জোড়া বিস্ফোরণে নিহত ২৮

  • ভিসা পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে নিলো যে দেশ

  • শন্তিপূর্ণভাবে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি: প্রধানমন্ত্রী

  • ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের পারমাণবিক অস্ত্র বাড়বে তিন গুণ

  • তানজানিয়ায় প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৯

  • ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার বেশি থাকলে বেশি কর

  • কাতার বিশ্বকাপে ফিরছে জিদানের সেই ভাস্কর্য

  • ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞায় তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া

  • অবিশ্বাস্য কীর্তিতে হাজার রানের ক্লাবে এনামুল বিজয়