পরিযায়ীসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশী পাখির অবাধ বিচরণের কারণে এক সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘোষণা করা হয়েছিল পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে। প্রতিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এ ধরনের এলাকায় গাছ কাটা ও নতুন স্থাপনা নির্মাণে সমীক্ষা চালানোসহ বেশকিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১টি অবকাঠামো নির্মাণের একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। প্রকল্প গ্রহণের আগে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বেশকিছু উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। যদিও এসব সুপারিশের বড় একটি অংশ পরিপালন করা হয়নি।
‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন’ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১৮ সালে। প্রকল্পে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১টি অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রথমে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সাল পর্যন্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে এর মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত করা হয়। প্রকল্পটির আওতায় প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবনের সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য হল, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ভবন ও খেলার কমপ্লেক্স নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।
এটি প্রণয়নের আগে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে একটি সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সমীক্ষায় পাওয়া ফলাফল ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে পাখিদের অবাধ চলাচল নিশ্চিতের জন্য ২০ মিটার বা ছয়তলার অতিরিক্ত উচ্চতার ভবন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়ক থেকে ন্যূনতম ১০০ মিটার দূরত্বে নির্মাণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষকদের জন্য নির্মাণাধীন টাওয়ার, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের টাওয়ার এবং গেস্ট হাউজ কাম রিসার্চার টাওয়ার নির্মাণের ক্ষেত্রে এ সুপারিশ মানা হয়নি। ভবনগুলোর উচ্চতা ১০-১১ তলা হলেও তা উল্লিখিত স্থানের মধ্যেই নির্মাণ করা হচ্ছে।
পাখির বিচরণস্থলে ভবনের উচ্চতার ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটি পরিযায়ী পাখি কোনো জায়গা বেছে নেয়ার আগে সে ওপর থেকে ওই জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করে। যখন ভবনগুলো পাঁচতলা বা তার কম হয়, তখন ভবনের ওপরে গাছপালার আচ্ছাদন থাকে। ফলে সে ওপর থেকে সবুজ অঞ্চল দেখতে পায়। কিন্তু যখন ভবন উঁচু হয়, তখন ভবনগুলো সবুজের ওপরে দেখা যায়। ফলে পাখি ওই এলাকা এড়িয়ে চলে। তাই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগরের মতো পাখি অধ্যুষিত এলাকায় আরো পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের প্রয়োজন ছিল।’
প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড় হাজার গাছ কেটে ফেলার প্রয়োজন দেখা দেয়। এজন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র সংগ্রহের পর নির্মাণকাজ শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে একটি প্রতিবেদনও জমা দেয়া হয়। ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর অনুমোদন পায় প্রতিবেদনটি। অনুমোদনপত্রে বন অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিতে বলা হয়। কিন্তু বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ না নিয়েই প্রায় দেড় হাজার গাছ কাটা হয়। আবার এখন পর্যন্ত বন অধিদপ্তরের সঙ্গেও এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এভাবে অবাধে গাছ কাটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত হয়ে আসছে পাখির আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্র।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখি বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রায় সারা বছরই পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় ২০৫ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। এছাড়া প্রতি বছর শীতে আগমন ঘটে ৩ থেকে ৭ হাজার পরিযায়ী পাখির। কিন্তু গত কয়েক বছরের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ সংখ্যা এখন ক্রমাগত কমছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত হাজার পাখি এসেছিল। এরপর ২০২১ সালের শীত মৌসুমে পাখির সংখ্যা কমে হয় সাড়ে চার হাজার। সর্বশেষ ২০২২ সালে মাত্র আড়াই থেকে তিন হাজার পরিযায়ী পাখি এসেছিল। এজন্য পরিবেশ দূষণ, উন্নয়ন প্রকল্পে পাখিদের অবাধ চলাচলের বিষয় বিবেচনা না করা ও অবাধে গাছ কাটাকে পাখির সংখ্যা হ্রাসের জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা যখন প্রথম জানতে পারি এ উন্নয়ন প্রকল্পে গাছ কাটা হবে, তখন ছাত্র-শিক্ষক সবাই মিলে উপাচার্যের কাছে গিয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন। আমরা কিছু ভবনের ক্ষেত্রে বিকল্প স্থানও দেখিয়েছিলাম কিন্তু তা আমলে নেয়া হয়নি। ফলস্বরূপ সবুজ ক্যাম্পাসও এখন ধীরে ধীরে ইট-পাথরের ক্যাম্পাসে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখিদের সংখ্যা কমার অন্যতম কারণ এ অপরিকল্পিত উন্নয়ন। পাখিরা এখন ওপর থেকে সবুজের পরিবর্তে ভবন দেখতে পাচ্ছে। ফলে তারা এ এলাকাকে এড়িয়ে চলছে।’
পাখিদের অবাধ বিচরণে প্রকল্পটির প্রভাব পড়ার বিষয়ে একমত বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবিরও। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সারা দেশেই পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ্যাতি রয়েছে। আমরা অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পরিযায়ী পাখি দেখতে যাই। কিন্তু সেখানে উন্নয়নের নামে যেভাবে পাখিদের বিচরণকে হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে, তা দুঃখজনক। তারা যা-ই বলুক না কেন যেসব জায়গায় উঁচু ভবন থাকে, সেসব জায়গায় পাখিদের বিচরণ স্বাভাবিক থাকে না। তাই জাহাঙ্গীরনগরের এ প্রকল্প যে পাখিদের অবাধ বিচরণে প্রভাব ফেলবে সেটি খুবই স্বাভাবিক।’
প্রকল্পটির বিষয়ে আপত্তি তুলেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগও (আইএমইডি)। সংস্থাটির ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে’ বলা হয়েছে, বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। প্রকল্পের আওতায় প্রায় দেড় হাজার গাছ কাটার প্রয়োজন থাকলেও বনায়ন খাতে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। নতুন অবকাঠামোগুলো পরবর্তী সময়ে পাখির অবাধ চলাচলে বাধার কারণ হয়ে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা করছে আইএমইডিও।
যদিও প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী নাসির উদ্দিনের দাবি, ‘বেশির ভাগ ভবনই সব নিয়ম মেনে তৈরি করা। দুয়েকটি ভবনের ক্ষেত্রে একটু হেরফের হতে পারে। আমাদের অনেকগুলো প্যারামিটার মেনে চলতে হয়। যেমন ভবনের আয়তন ঠিক রাখা, সংলগ্ন মাঠের আয়তন ঠিক রাখা। এসব প্যারামিটার ঠিক রাখতে গিয়ে একটু হেরফের হতে পারে। কিন্তু সরাসরি পাখিদের ফ্লাইং জোনে আমরা কোনো ভবন নির্মাণ করিনি। আমরা নিয়মানুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছিলাম। সেখান থেকে পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ) করার কথা বলা হয়েছিল। তাদের লোক পাঠিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। আইএমইডি ও পরিকল্পনা কমিশন দেখেছে। ইআইএ এখন ছাড়পত্রের সমান। আর ছাড়পত্র প্রকল্প সম্পন্ন হলে দেয়া হবে বলে বলা হয়েছে।’
প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘আমরা নতুন গাছ লাগানো নিয়ে বন অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা না করলেও অনেক বৃক্ষ রোপণ করছি। দেড় হাজার গাছ কেটেছি। কিন্তু বিপরীতে অন্তত দুই হাজার গাছ লাগিয়েছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গাছ রয়েছে। তাই পাখিদের বাসস্থানে প্রভাব ফেলবে না।’
যদিও গাছ কেটে ফেলার পর পাখিরা বিশ্ববিদ্যালয়েই কোনো গাছে আবাস করবে এমনটা ভেবে নেয়া ঠিক নয় বলে মনে করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও পাখি বিশেষজ্ঞ ড. আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মানুষ তো পাখিকে গিয়ে বলতে পারে না; এ গাছটা আমাদের কাটতে হবে তোমরা অন্য কোথাও গিয়ে থাকো। একটা পাখি সবকিছু বিবেচনা করে ঠিক করে সে কোথায় থাকবে, কোথায় থাকবে না। তাই যে গাছে বসবাস করে সে গাছ কাটলেও যে সেখানেই অন্য কোথাও গিয়ে থাকবে বিষয়টা এমন নয়। এজন্য তাকে তার অনুকূল পরিবেশ দিতে হবে। দিতে না পারলে সে কোনোভাবেই থাকবে না।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়