চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার এক লাখ পরিবার চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। উপজেলার ভূগর্ভের পানিতে মাত্রারিক্ত আর্সেনিক থাকায় এ ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু গভীর নলকূপ স্থাপন করলেও এমন ভয়াবহতা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের তথ্যমতে, ১৮ বছর আগে অর্থাৎ ২০০২-২০০৩ সালের নাগাদ এখানকার গ্রামে গ্রামে নলকূপগুলোর পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা নিরূপণ করা হয় এবং একই সময় আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের কারণে আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত ৪০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। বর্তমানে উপজেলার ৫০ ভাগ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে।
২০০৩ সালের পর থেকে এখানকার নলকূপগুলোর পানি পরীক্ষা এবং আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে গত এক যুগের বেশি সময় ধরে আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত রোগীর কোনো পরিসংখ্যান নেই উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের দেয়া তথ্য মতে, ২০০২-০৩ অর্থ বছরে উপজেলার ৭৫ হাজার ৩৬৬ পরিবারের ৩২ হাজার ৪৮০টি নলকূপের পানিতে আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষার আওতায় আসা নলকূপের পানিতে গড়ে ৩৯ দশমিক ৭৭ মাত্রায় আর্সেনিক থাকার বিষয়টির প্রমাণ মেলে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৮৩৩টি নলকূপের প্রতি লিটার পানিতে দশমিক ০৫ মিলিগ্রামের অধিক মাত্রায় আর্সেনিকের শনাক্ত করে নলকূপগুলোর পানি পান না করতে লাল রঙ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।
২০০২-০৩ সালে চালানো পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, মিরসরাই পৌরসভায় শতকরা ৬৬ দশমিক ৮৩ ভাগ, খইয়াছড়ায় ইউনিয়নে ৬৬.২৯ ভাগ, মায়ানী ইউনিয়নে ৫৬.১১ ভাগ, মিরসরাই সদর ইউনিয়নে ৬০ দশমিক ৯৬ ভাগ, ওয়াহেদপুর ইউনিয়নে ৫১ দশমিক ৭৯ ভাগ, ওচমানপুর ইউনিয়নে ৫১ দশমিক ২০ ভাগ, ধুম ইউনিয়নে ৫১ দশমিক ০৯ ভাগ, কাটাছরা ইউনিয়নে ৪৭ দশমিক ৬৬ ভাগ, হাইতকান্দি ইউনিয়নে ৪৫ দশমিক ৩৩ ভাগ, দূর্গাপুর ইউনিয়নে ৪৪ দশমিক ০৫ ভাগ, মঘাদিয়া ইউনিয়নে ৪০ দশমিক৩৪ ভাগ, মিঠানালা ইউনিয়নে ৩৯ দশমিক ৮৫ ভাগ, ইছাখালী ইউনিয়নে ৩৯ দশমিক ১৭ ভাগ ও সাহেরখালী ইউনিয়নে ৩০ দশমিক ৩৬ ভাগ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক শনাক্ত করা হয়।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সহকারি প্রকৌশলী কে এম সাঈদ মাহমুদের মতে, মিরসরাইয়ে আর্সেনিক থেকে মুক্তি পেতে এক লাখ পরিবারের প্রতি ১০ পরিবারের জন্য একটি করে গভীর নলকূপ স্থাপন করা খুব জরুরি। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত ১৪ বছরে পুরো উপজেলায় মাত্র ৪৪১টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১১২০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। হিসেব মতে, উপজেলার তিন লাখ ৬৮ হাজার ৯৫০ জন মানুষের জন্য গভীর নলকূপ রয়েছে মাত্র এক হাজার পাঁচ শ’ ৬১টি।
অপর দিকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের সাধারণ টিউবয়েলগুলোতে উঠছে না পানি। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই অংশের পূর্ব পাশে অপরিকল্পীতভাবে ওমেরা বিএসআরএম, সিপি সহ অসংখ্য শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এসব শিল্পকারখানায় পানি ব্যবহার করা হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে। ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সাধারণ টিউবয়েলে পানি উঠছে না। অবশ্য গত দুই বছরে উপজেলার ১৬ ইউনিয়নে ৮৩২টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।
২০০২-০৩ সালে সরকারিভাবে আর্সেনিকের ওপর জরিপ চালানোর আগে ২০০১ সালে মিরসরাইয়ে নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা নিরূপণ করতে জরিপ চালায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকা। ওই সময় উপজেলার অধিকাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক শনাক্ত হলে সুদমুক্ত ঋণে মিরসরাই সদর ও উপকূলীয় ইছাখালী ইউনিয়নে চার লাখ টাকা ব্যয়ে পৃথক দুইটি বিশুদ্ধ পানির প্ল্যান্ট স্থাপন করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরসরাই সদরের প্ল্যান্টটি দিয়ে ৭০-৮০ পরিবারের বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মিটলেও মোট জনসংখ্যার তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল। বর্তমানে আর্থিক ও ব্যবস্থাপনা সঙ্কটে সেটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। ইছাখালী ইউনিয়নের প্ল্যানটির বিশুদ্ধ পানি ওই এলাকার জনগণ অর্থের বিনিময়ে কিনে পান না করায় প্ল্যান্ট মালিক লোকসান গুণে সেটি বন্ধ করে দেয়।
প্ল্যান্ট মালিক আবুল কালাম আজাদ জানান, এলাকার মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলেও অর্থ দিয়ে আর্সেনিক মুক্ত পানি পান করতে চাচ্ছে না। ফলে প্রশিকার এক লাখ ১৯ হাজার টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ২০০৯ সালে প্ল্যান্টটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকার মিরসরাই অফিসের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ায় এ বিষয়ে সংস্থাটির কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য নেয়া যায়নি।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার অধিকাংশ এলাকার নলকূপের পানিতে আর্সেনিক বিষ থাকলেও এখন কোথাও কোনো নলকূপে আর্সেনিক শনাক্তকরণ লাল রঙের চিহ্ন নেই। ২০০১ সালে প্রশিকা নলকূপের পানি পরীক্ষার মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকযুক্ত নলকূপগুলোতে লাল চিহ্ন দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করলেও সে চিহ্নগুলো এখন মুছে গেছে। ফলে উপজেলার হাজার হাজার মানুষ এখন ওই নলকূপগুলোর আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।
এদিকে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকযুক্ত পানি পানে মানুষ কী ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে জানতে চাইলে মাতৃকা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. জামসেদ আলম বলেন, আর্সেনিক বিষ মানবদেহে পচন রোগ, কিডনির সমস্যা, ক্যান্সার, হাত পায়ের তালুতে চর্মরোগের সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং এ রোগ থেকে মুক্তির জন্য উপজেলাজুড়ে পর্যাপ্ত গভীর নলকূপ স্থাপন খুবই জরুরি।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়