উন্নত জীবনযাপনের ‘আমেরিকান ড্রিম’ চোখে নিয়ে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাচ্ছেন বহুসংখ্যক বাংলাদেশী। যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর (ইউএসসিবি) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের শেষে সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ ৬৪ হাজার। এর মধ্যে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজারের কিছু বেশির। দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশীদের খানাপিছু গড় বার্ষিক আয় ৬৮ হাজার ডলারের কিছু কম।
ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিস্টিকসের (্ইউএসবিএলএস) হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২১ সালে খানাপিছু গড় ব্যয় ছিল প্রায় ৬৭ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশী খানাগুলোর উপার্জনকারীরা গোটা বছরজুড়ে আয় করেছেন দেশটির গড় খানাপিছু ব্যয়ের চেয়ে সামান্য বেশি। এ হিসাব আমলে নিলে বাংলাদেশী পরিবারগুলোর উদ্বৃত্ত বা সঞ্চয়ও খুব বেশি হওয়ার কথা না। যদিও এ যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশীরাই এখন দেশের রেমিট্যান্সের সবচেয়ে বড় উৎস।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যেক বাংলাদেশী প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে। যদিও সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের বক্তব্য হলো প্রতি মাসে জীবনযাপনের ব্যয় বহন করে দেশে ২ হাজার ডলার পাঠানো বেশির ভাগ বাংলাদেশী প্রবাসীর পক্ষেই প্রায় অসম্ভব।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সৌদি আরবে শ্রমিক হিসেবে গিয়েছেন ৫৪ লাখের বেশি বাংলাদেশী। এছাড়া দক্ষ পেশাজীবী হিসেবেও সেখানে অবস্থান করছেন আরো অনেকে। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এ বিপুলসংখ্যক সৌদিপ্রবাসী বাংলাদেশীর চেয়েও বেশি অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীরা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বাংলাদেশীদের বড় একটি অংশ সেখানে আছেন শিক্ষার্থী হিসেবে। শিক্ষার্থীদের পক্ষে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি ও সেখানে বসবাসের খরচ বহন করে দেশে এত বিপুল অংকের অর্থ পাঠানো সম্ভব নয়। উপরন্তু দেশটিতে মূল্যস্ফীতি এখন প্রকট আকার নিয়েছে। এ মূল্যস্ফীতির কারণেই মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড) সম্প্রতি আগ্রাসী মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের পথ থেকে সরে এসেছে। সে হিসেবে দেশটি থেকে এত বিপুল পরিমাণ অংক বাংলাদেশে রেমিট্যান্স হিসেবে আসার বিষয়টি বিস্ময়কর।
অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যটিকেই বলা চলে বিশ্বের চতুর্থ সর্ববৃহৎ অর্থনীতি। অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর অঙ্গরাজ্যটিতে কাজের সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া প্রবাসী ও শিক্ষার্থীদের অনেকেই সেখানে বসবাস করছেন। এমনই একজন মোহাম্মদ আবু বকর। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছেন তিনি। আবু বকর জানালেন, সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের অধিকাংশই মূলত শিক্ষার্থী। তাদের পক্ষে সেখানে পড়াশোনার চাপ সামলে নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি অর্থ উপার্জন করা অনেক কঠিন।
বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘যারা এখানে শিক্ষার্থী ভিসায় আসে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের কাউকে কাউকে টিউশন ফির জন্য দেশে পরিবারের মুখাপেক্ষী হতে হয়। আবার কাজ করে সব সময়ই যে এক রকম আয় হয়, তাও না। সব জায়গায় সব সময়ে কাজ পাওয়া যায় না। বিশেষ করে ইদানীং বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী-অভিবাসী আসায় কাজ পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে গেছে।’
এছাড়া অভিবাসীদের সেখানে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিরও মুখোমুখি হতে হয়। এমনকি স্বীকৃত-দক্ষ পেশাজীবীদেরও বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে। এমনই এক ব্যক্তির কঠিন সময়ের মধ্যে দিনযাপনের গল্প উঠে এসেছে এশিয়া সোসাইটির ম্যাগাজিনে ‘আমেরিকান ড্রিম অব বাংলাদেশী’ শীর্ষক এক নিবন্ধে। মার্কিন গ্রিন কার্ড লটারির বিজয়ী হিসেবে ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান অ্যাকাউন্ট্যান্ট মোহাম্মদ চিশতি শিপু। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের একটি খুপরি ঘরে আরো চারজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে একটি কক্ষে বসবাস করতে হয়েছে তাকে। সেখানে কিছুদিনের মধ্যে একটি চাকরি পেলেও চাকরিদাতার শর্ত মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। সেখানে তাকে নগদ অর্থে ও বিনা চুক্তিতে বেতন পরিশোধের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বৈধ নিয়োগপত্র ছাড়া এভাবে চাকরি করতে রাজি হননি তিনি। কিন্তু কোনো মার্কিন প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে চাকরির পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় সে সময় তার জন্য অনেক মুশকিল হয়ে পড়েছিল। ছোটখাটো নানা অড জব করে বেশ কিছুদিন চলতে হয়েছে তাকে। পরে একটি হোটেলে কাজ করার সময় সেখানকার অ্যাকাউন্ট্যান্ট চাকরি ছেড়ে দিলে সেখানে নিজের প্রকৃত পেশাগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সুযোগ পান মোহাম্মদ চিশতি শিপু।
গত দুই-তিন বছরে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের সিংহভাগই শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশের পক্ষেই ভিনদেশে ভিন পরিবেশে দ্রুত মানিয়ে নিয়ে চলার মতো উপার্জন করাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন সেখানে বসবাসরতরা।
আবার সেখানে বসবাসরত অন্য বাংলাদেশীদের অবস্থা এশিয়া মহাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসীদের গড় পরিস্থিতির তুলনায়ও বেশ শোচনীয়। ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত পরিচালিত আমেরিকান কমিউনিটি সার্ভের (আইপিইউএমএস) তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশীদের ১৯ শতাংশই দরিদ্র অবস্থায় রয়েছে। যদিও এশিয়া মহাদেশের অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এর হার ১০ শতাংশ।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী খানাগুলোর বার্ষিক গড় আয়ও এশিয়া অঞ্চলের খানাপিছু বার্ষিক আয়ের নিচে বলে পিউ রিসার্চের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের মধ্যে (২৫ বছর বা এর বেশি বয়সী) ৩৫ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা আটকে আছে হাইস্কুলের গণ্ডিতে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী এশীয়দের ক্ষেত্রে এ গড় হার ২৭ শতাংশ।
অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছেন ব্যাংক নির্বাহীরা। দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে, সেটি দেখে তারা নিজেরাও বিস্মিত। হঠাৎ করে দেশটি থেকে রেমিট্যান্সে প্রবাহের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটি বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ব্যাংকগুলো মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে রেমিট্যান্স কিনে নেয়। মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান কী প্রক্রিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে ডলার কিনছে, সেটি জানা সম্ভব নয়।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান গন্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি এখন রেমিট্যান্সেরও প্রধান উৎস। দেশে ডলারের দর ভিন্ন হওয়ায় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ রফতানি আয়ের অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবেও আনতে পারেন। রেমিট্যান্সের ডলারের দর রফতানি আয়ের চেয়ে বেশি। আবার রেমিট্যান্সের ওপর সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনাও রয়েছে।’
ব্যাংকারদের একাংশের সন্দেহ, রেমিট্যান্সের উৎস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানে উঠে আসার পেছনে অর্থ পাচারের যোগসাজশ থাকলেও থাকতে পারে। তাদের ভাষ্যমতে, এমনও হতে পারে কেউ হয়তো কালো টাকা যুক্তরাষ্ট্রে গোপনে পাচার করে সেটিই আবার রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে ফেরত আনছেন বৈধ আয় হিসেবে। এ বিষয়ে আরো গভীরে গিয়ে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়