যুদ্ধের প্রভাবে পোশাক ক্রয়ে লাগাম টানতে শুরু করেছে ক্রেতারা

ক্রয়াদেশ কমানোর বিষয়ে সহযোগিতা চেয়ে বাংলাদেশের কিছু কারখানায় সম্প্রতি বার্তা পাঠিয়েছে ইউরোপভিত্তিক এক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। ইঅ্যান্ডএইচ নামের ওই ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পাঠানো বার্তায় বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি ইউরোপ পরিস্থিতির অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটেছে। যুদ্ধ দুই দেশের মধ্যে হলেও প্রভাব দেখা যাচ্ছে বৈশ্বিক। প্রধান মুদ্রা, কাঁচামাল, জীবাশ্ম জ্বালানির দাম বাড়ছে। ব্যবসার প্রেক্ষাপটগুলোয়ও প্রভাব পড়ছে। রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বাজার। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশগুলোর বিক্রয়কেন্দ্র ও পরিবেশকদের জন্য ক্রয়াদেশ কমিয়ে আনতে হবে।’

ইঅ্যান্ডএইচ বলেছে, বিদ্যমান পরিস্থিতি অবশ্যই ক্ষতির মুখে ফেলবে, কারণ এরই মধ্যে কাপড় ও অ্যাকসেসরিজের ক্রয়াদেশ দিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অবশ্যই ব্যবসার ওপর সার্বিক সংকটের প্রভাব কমাতে হবে। যার জন্য ঝুঁকি ভাগ করে নিতে হবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। পরিবহন ব্যয় বেড়ে হয়েছে সবসময়ের চেয়ে বেশি। এ অবস্থায় আগামী মৌসুমের ক্রয়াদেশগুলোর পুনরায় পর্যালোচনার বিষয়ে সহায়তার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, ইঅ্যান্ডএইচ এরই মধ্যে বাংলাদেশের কারখানায় দেয়া পোশাকের ক্রয়াদেশগুলো স্থগিত করেছে।

আগামী মৌসুমে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির ক্রয়াদেশ কমানো পূর্বাভাস মূলত রাশিয়ার বাজারকে কেন্দ্র করে। কিন্তু গোটা ইউরোপের বাজারের জন্য পোশাকের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্রয়াদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে শুরু করেছে। দেশের পোশাক রফতানিকারক কারখানা কর্তৃপক্ষ, ইউরোপভিত্তিক একাধিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানিয়েছেন, যুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাবের শঙ্কায় ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দেয়ার বিষয়ে ধীরগতিতে চলার নীতি অনুসরণ করতে শুরু করেছে। আগামী মৌসুমের জন্য পোশাকের নমুনা উন্নয়ন হলেও সেগুলো নেয়ার বিষয়ে ক্রেতাদের তাগিদে ভাটা দেখা যাচ্ছে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ইউরোপভিত্তিক বড় এক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা কাজ করছি এবং সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছি। পোশাক কারখানা মালিকরা জানিয়েছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ক্রেতারা সবাই শঙ্কিত। পোশাকের সঙ্গে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের একধরনের সংযোগ রয়েছে। কারণ এ দেশগুলোর উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের ওপর গোটা ইউরোপের নির্ভরশীলতা কম নয়। বর্তমানে সরবরাহ চেইনটা বিঘ্নিত হয়েছে। খাদ্যপণ্যের ঘাটতি দেখা দিতে শুরু করেছে। মৌলিক চাহিদার মধ্যে প্রথমেই আসে খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয়। খাদ্যের ওপর যখন চাপ পড়তে শুরু করেছে, এর রেশটা বস্ত্রের ওপর পড়াটা খুবই স্বাভাবিক।

পোশাক পণ্যের অন্যতম বড় রফতানিকারক গ্রুপ মাইক্রো ফাইবার। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (অর্থ) ড. কামরুজ্জামান কায়সার বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থবছরের এ সময়টায় তৃতীয় বা চতুর্থ মৌসুমের ক্রয়াদেশ আসে। কভিড পরিস্থিতি ছাড়া প্রতি বছর এ সময়ে যে ক্রয়াদেশ আসে, সেই প্রবাহ এখন নিম্নমুখী। যুদ্ধের বিষয়টি সব জায়গায়ই নাড়া দিয়েছে, বিভিন্নভাবে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোয় প্রভাবও পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কা দেখা দিয়েছে। জার্মানিসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে ইনফ্লেশন শুরু হয়ে গেছে। কভিড সামগ্রিকভাবে আমাদের অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়াতেও শুরু করেছিলাম। এখন আবার নতুন দুর্যোগের কারণে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায় অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, শঙ্কা আসছে। অনেকের ক্রয়াদেশ কমে গেছে বা কমছে। অনেকে বার্তা পাচ্ছে।

দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের একটি সূত্র জানিয়েছে, তাদের কারখানা আগামী মে পর্যন্ত শতভাগ বুক ছিল। তবে পরে যুদ্ধের প্রভাব পড়বে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিপণন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এরই মধ্যে তা বোঝা যাচ্ছে। আগামী মৌসুমের নমুনা যেগুলো উন্নয়ন পর্যায়ে ছিল, ক্রেতারা সেগুলো নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কারণ অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সেই অনুযায়ী ক্রেতারা চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে যুদ্ধের প্রভাব পড়বে এটা নিশ্চিত।

পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন প্রতিনিধিরা বলছেন, যুদ্ধজনিত সার্বিক পরিস্থিতির প্রভাবের কারণেই ক্রেতারা এখন ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ মানসিকতা প্রকাশ করছে। মানুষ যেহেতু খাদ্য কিনতে পারছে না, পোশাক পণ্য নিয়ে শঙ্কার মধ্যে পড়ে গিয়েছে। ফলে ক্রেতারা ভাবছে এত বেশি ক্রয়াদেশ দিয়ে পণ্য ওয়্যারহাউজে মজুদ হবে। এজন্য তারা কিছুটা ধীরে চলো নীতিতে চলে গেছে। আমাদের কাছে ক্রয়াদেশ নিয়ে আলোচনাগুলোও সেই আঙ্গিকেই আসছে।

বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বণিক বার্তাকে বলেন, ক্রেতারা এখন পরিস্থিতি দেখছে, পর্যবেক্ষণ করছে। গোটা ইউরোপে এ অবস্থা। শুধু রাশিয়ার জন্য ক্রয়াদেশ দেয়া ক্রেতারা না, গোটা ইউরোপের জন্য পোশাক ক্রয় করে এমন ক্রেতারা এখন সার্বিক পরিস্থিতি দেখছে, অবস্থা কোথায় গিয়ে গড়ায় তা পর্যবেক্ষণ করছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ইনফ্লেশনও বাড়ছে। কিছুদিন ধরে আগের মতো ব্যাপক হারে ক্রয়াদেশের বিষয়ে আলোচনা কম। কভিড-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে ক্রয়াদেশে বড় ধরনের গতি দেখা যাচ্ছিল। সেই গতির তীব্রতা এখন থেমে গেছে। ক্রেতারা আস্তে আস্তে লাগাম টানছে। বিশেষ করে ইউরোপের বাজারে রাতারাতি ক্রয়াদেশ আসা কমে গেছে। না নিলেই নয় এমন পোশাক নিচ্ছে ক্রেতারা। যুদ্ধ পরিস্থিতি কোথায় মোড় নেয়, সেটা সবাই পর্যবেক্ষণ করছে। সার্বিকভাবে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কবে নাগাদ এ পরিস্থিতি ঠিক হবে বলা মুশকিল।

জানা গেছে, কভিড-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ স্থানান্তর হচ্ছিল। বিশেষ করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পোশাক সরবরাহকারী চীন থেকে সরে আসা ক্রয়াদেশের গতি সার্বিক ক্রয়াদেশে বড় উল্লম্ফন সৃষ্টি করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিকগুলোর পাশাপাশি ইউরোপভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশও আসতে শুরু করেছিল অতিরিক্ত পরিমাণে। এ চিত্র উঠে আসে চলতি মাসেই প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যালোচনায়ও। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন পোশাক রফতানিকারকরা।

পোশাক শিল্প মালিকরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে ক্রয়াদেশ বৃদ্ধির একটা প্রবণতা আছে। এ বৃদ্ধির পুরোটাই স্থানান্তর নয়। অর্থাৎ ক্রয়াদেশ যে বাড়ছে তার মধ্যে চাহিদা বৃদ্ধি ও স্থানান্তর দুটোই আছে। স্থানান্তর হচ্ছে মূলত যে ক্রয়াদেশ চীনারা পেত সেটা। এছাড়া কিছুটা ভিয়েতনাম থেকেও হয়েছে। দেশটিতে কভিডের প্রভাবে লকডাউন কার্যকর হওয়ার ফলে তখন ক্রয়াদেশগুলো বাংলাদেশে সরে এসেছে। সামগ্রিকভাবে ক্রয়াদেশ বৃদ্ধির যে গতি তা কভিড-পরবর্তী অতিরিক্ত চাহিদার কারণে। ক্রেতাদের মজুদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফলে ক্রয়াদেশ হঠাৎ করেই বেড়েছে। একটা পর্যায়ে উপচে পড়েছে। কিন্তু এখন যুদ্ধ পরিস্থিতি ক্রয়াদেশ বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।

নিট পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, হঠাৎ করে ১০-১৫ দিন ধরে ক্রয়াদেশ শ্লথ হয়ে গেছে। যে গতিতে ক্রয়াদেশগুলো আসছিল তা কমেছে। ক্রয়াদেশগুলোর গতি এখন কম। সুনির্দিষ্ট করে পোল্যান্ডের ক্রয়াদেশ শ্লথ হয়েছে এবং হচ্ছে। পোল্যান্ডের বিপুল পরিমাণ পোশাক পণ্য বাংলাদেশ থেকে যায়। এসব পণ্যের বেশির ভাগই পোল্যান্ড থেকে রাশিয়া যেত। পোল্যান্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশিয়ায় কোনো পণ্য পাঠাবে না। এতে ক্ষতি পোল্যান্ডেরই। কারণ পণ্য আমদানির অনেক বিকল্প রাশিয়ার আছে। তবে ১০-১৫ দিন ধরে সব ক্রেতাদের ইনকোয়্যারির গতি কম।
এই বিভাগের আরও খবর
রোজায় বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

রোজায় বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

যুগান্তর
এস আলমের শেয়ার বিক্রি করে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে: ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান

এস আলমের শেয়ার বিক্রি করে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে: ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান

প্রথমআলো
ব্যাংকের ওপর আস্থা কমায় টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনছে মানুষ

ব্যাংকের ওপর আস্থা কমায় টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনছে মানুষ

কালের কণ্ঠ
বিদ্যুৎ নিয়ে আদানির সাথে হওয়া চুক্তি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট

বিদ্যুৎ নিয়ে আদানির সাথে হওয়া চুক্তি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট

নয়া দিগন্ত
প্রাইম ব্যাংক ও সেবা ডট এক্সওয়াইজেডের মধ্যে চুক্তি সই

প্রাইম ব্যাংক ও সেবা ডট এক্সওয়াইজেডের মধ্যে চুক্তি সই

বাংলা ট্রিবিউন
ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু

ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু

বাংলা ট্রিবিউন
ট্রেন্ডিং
  • সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে 'বস্তায় বস্তায় ঘুষ' নেওয়ার অভিযোগ: দুদকের অনুসন্ধান শুরু

  • ভালোবাসা দিবসে পরী মনির ‘বুকিং’

  • নির্বাচনের আগে পাকিস্তানে জোড়া বিস্ফোরণে নিহত ২৮

  • ভিসা পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে নিলো যে দেশ

  • শন্তিপূর্ণভাবে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি: প্রধানমন্ত্রী

  • ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের পারমাণবিক অস্ত্র বাড়বে তিন গুণ

  • তানজানিয়ায় প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৯

  • ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার বেশি থাকলে বেশি কর

  • কাতার বিশ্বকাপে ফিরছে জিদানের সেই ভাস্কর্য

  • ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞায় তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া