রফতানি তথ্যের অসংগতি কাটছেই না

বাংলাদেশে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ রফতানি আয়। সরকারের ভিন্ন পরিসংখ্যানের কারণে রফতানির প্রকৃত তথ্য নিয়ে আগে থেকেই সন্দেহ পোষণ করে আসছিলেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, পণ্যের রফতানি পরিমাণে কমলেও অর্থমূল্যে বেড়েছে। যদিও বড় রফতানিকারকদের প্রায় সবাই বলছেন, গত অর্থবছরে তাদের পণ্যের রফতানি কমেছে। আবার রফতানির বিপরীতে দেশে আসা প্রাপ্ত অর্থের মধ্যেও রয়েছে গরমিল। সব মিলিয়ে আবারো রফতানির তথ্য নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। 

এরই মধ্যে ইপিবি ২০২২-২৩ অর্থবছরের রফতানির পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরে ৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য ও সংশ্লিষ্ট রফতানিকারকরা বলছেন, গত অর্থবছরে রফতানি পরিমাণে যতটা কমেছে তাতে ৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের রফতানির তথ্য আরো যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজন রয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বন্দর দিয়ে পণ্য রফতানি হয় ১৯ লাখ ২৫ হাজার টন। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রফতানি হয়েছিল ১৯ লাখ ৩৩ হাজার টন পণ্য। এ অনুযায়ী, টনের হিসাবে রফতানি কমেছে শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশেরও বেশি।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থমূল্য বিবেচনায় রফতানি হয় ১ হাজার ২৪৯ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে পণ্য রফতানি হয়েছিল ১ হাজার ১০২ কোটি ২০ লাখ ডলারের। এ হিসাবে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রফতানি বেড়েছে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

একই পরিস্থিতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তথ্যেও। এ সময়ে পণ্য রফতানির পরিমাণ ১৮ লাখ ৫২ হাজার টন। আগের অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় রফতানি কমে ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ। যদিও অর্থমূল্যে পণ্য রফতানি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বেড়েছে ৮ দশমিক ৩১ শতাংশ।

২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে পরিমাণ বিবেচনায় রফতানি হয় ১৭ লাখ ৪৫ হাজার টন, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ৩২ শতাংশ কম। কিন্তু অর্থমূল্য বিবেচনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে রফতানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৬২ শতাংশ।

বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের রফতানিকারকদের মধ্যে প্রায় এক ডজন রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বণিক বার্তা। তাদের প্রায় সবাই বলেছেন, গত অর্থবছরে তাদের প্রতিষ্ঠানের রফতানি কমেছে ৫ থেকে ১০ শতাংশ। 

তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রেও দেখা যায় রফতানি থেকে তাদের আয় কমেছে। আর্গন ডেনিমস লিমিটেডের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, সর্বশেষ ২০২২-২৩ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিক (জুলাই-মার্চ) সময়ে কোম্পানিটির রফতানি থেকে আয় হয়েছে ৩১৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। যেখানে এর আগের হিসাব বছরের একই সময়ে আয় ছিল ৩৪০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে উল্লিখিত সময়ে কোম্পানিটির আয় কমেছে ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

তালিকাভুক্ত আরেক কোম্পানি এসকোয়্যার নিট কম্পোজিট পিএলসি ২০২২-২৩ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে রফতানি থেকে ৬০৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা আয় করেছে। যেখানে এর আগের হিসাব বছরের একই সময়ে আয় ছিল ৭২৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এ সময়ের ব্যবধানে কোম্পানিটির আয় কমে ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে রফতানি হয় ১ হাজার ৪৪১ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য। এ সময়ে রফতানির বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ৫৩ কোটি ডলার। এ হিসাবে শুধু এক প্রান্তিকেই রফতানি ও প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে পার্থক্য ছিল প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের। 

রফতানি তথ্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করছেন খোদ রফতানিকারকরা। তারা বলছেন, সরকারের পরিসংখ্যানের সঙ্গে ক্রয়াদেশ পরিস্থিতির তুলনামূলক বিশ্লেষণে হিসাব মিলছে না। অনেকে বলতে পারেন, আমদানি করা তুলা ও সুতার উচ্চমূল্যের প্রভাবে অর্থমূল্যে রফতানি বেড়েছে। কিন্তু সেটাও ঠিক নয়। কারণ যে সুতার দাম ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল কেজিপ্রতি ৫ ডলার, সে সুতার মূল্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে হয় ৩ ডলার ১০ বা ২০ সেন্ট। ফলে পরিমাণে কমলেও অর্থমূল্যে রফতানি বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করছেন তারা। তাদের দাবি, সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। 

রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডলারে কীভাবে রফতানি বাড়ল তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সরকারি তথ্যের সঙ্গে আমাদের হিসাব কোনোভাবেই মিলছে না। পরিমাণে যদি কমে থাকে তাহলে ডলারে বাড়ল কেন? আবার বড় রফতানিকারকরা বলছেন তাদের রফতানি কমেছে। তাহলে রফতানি বাড়ল কাদের? ২০২১-২২-এর চেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুতার দামও বেশ কম ছিল। ৫ ডলারের সুতার দাম নেমে এসেছিল ৩ ডলার ১০ বা ২০ সেন্টে।’

তিনি বলেন, ‘সুতার দাম কমলেও পোশাকের দামও স্বাভাবিকভাবেই কমে। ফলে ডলার ভ্যালু বাড়ার কথা নয়। পরিমাণে কমলে ডলারে বাড়ল কেন—এর কোনো ব্যাখ্যা আমাদের কাছে নেই। গত অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের নভেম্বরে যখন রফতানির অর্থমূল্য ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি দেখানো হলো, তখনই আমি বলেছিলাম যে হিসাব মিলছে না। এখনো সংগঠনের ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশনের যে তথ্য তার সঙ্গে তুলনা করলেও হিসাব মেলে না। সরকারি তথ্য চ্যালেঞ্জ করছি না কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে এ হিসাব মেলে না।’ 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকে রফতানির তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে এবং তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তারা বলছেন, যারা বাণিজ্য করছে, তারা ওভার-আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থ দেশের বাইরেই রাখছে। এগুলো শনাক্ত করার যথেষ্ট পথ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে রয়েছে, কিন্তু তারা তা করে না। এখানে বলা হলো রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু তা আসলে অর্থমূল্যে। যদিও এখানে দেখার প্রয়োজন কী পরিমাণ পণ্য রফতানি হয়েছে। ভিন্নতার কারণে হিসাবের গ্রহণযোগ্যতা বা আস্থা এবং এর সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ভিন্ন পরিসংখ্যানে নীতি প্রণয়নেও সমস্যা হয়। যেমন ভুল পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে শুল্ক আরোপ করা হলে তার কার্যকারিতা থাকে না। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি ভুল পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে প্রণোদনা দেয়, সেখানেও জটিলতা সৃষ্টি হয়। আসল কথা হচ্ছে সব তথ্য ও পরিসংখ্যানের সমন্বয় থাকা উচিত। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমদানি-রফতানির মাধ্যমে অনিয়ম সংঘটিত হয়, সেটা ঠিক। যথাযথ নজরদারি ও তদারকির মাধ্যমে এগুলো কমিয়ে আনা প্রয়োজন। তবে কাঁচামালের দাম যখন বাড়ে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দামের প্রভাব যখন পড়ে, তখন পরিমাণ কম হলেও ডলার মূল্যে বেশি হবে। বিশ্লেষণে দেখেছি মূল্যের একটা প্রভাব আছে। অর্থমূল্য বেড়েছে, যার বড় কারণ কাঁচামালের দাম বেড়েছে। আবার ডলার হয়তো রেখে দিচ্ছে, পরে দাম বাড়বে সেই জন্য অপেক্ষা করছেন রফতানিকারকরা। সেটা যে একেবারেই হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। কিন্তু আমার বিশ্লেষণে দেখেছি গত অর্থবছরে মূলত কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে রফতানিতে।’

একই ধরনের কথা বলছেন পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতিও। জানতে চাইলে ফারুক হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ছিল রফতানির তথ্যে। বিশ্বব্যাপী ক্রয়াদেশ কমায় আমাদের ক্রয়াদেশও কমেছে। আমাদের কাঁচামালের দাম বেড়ে গিয়েছিল, ফলে আমাদের পণ্যের ইউনিট প্রাইস বেশি দেখা গেছে। ফলে ক্রয়াদেশ কম, কোয়ান্টিটি কমের মধ্যেও প্রবৃদ্ধি ছিল। এছাড়া রফতানি বাড়ার আরো একটি কারণ আমরা ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য রফতানি করেছি। আগে ১০ ডলারের জ্যাকেট রফতানি করেছি কিন্তু এখন ৬০ ডলারের জ্যাকেটও রফতানি করছি।’

রফতানি-সংক্রান্ত জাতীয় পরিসংখ্যান হিসাবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যকেই উপস্থাপন করা হয়। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের পণ্য রফতানির অর্থমূল্য প্রথমবার ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সময়ে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু অন্য দুই সংস্থার তথ্যে রফতানির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৫০ বিলিয়নের নিচে। 

বরাবরই এ পরিসংখ্যানের ভিত্তি হিসেবে এনবিআরের তথ্যের কথা উল্লেখ করে ইপিবি। কিন্তু এনবিআরের হিসাব রক্ষণাবেক্ষণের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা অ্যাসাইকুডার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দর ও ঢাকা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া মোট পণ্যের অর্থমূল্য ছিল ৪ হাজার ৮০ কোটি বা ৪০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। এখানে মোংলা থেকে পণ্য রফতানির তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এই বিভাগের আরও খবর
টোল আদায়ে দেড় হাজার কোটির মাইলফলকে পদ্মা সেতু

টোল আদায়ে দেড় হাজার কোটির মাইলফলকে পদ্মা সেতু

বাংলা ট্রিবিউন
টানা ৩ দিন ধরে কমছে সোনার দাম

টানা ৩ দিন ধরে কমছে সোনার দাম

দৈনিক ইত্তেফাক
বোতলের সয়াবিন তেলের লিটার ১৬৭, খোলা ১৪৭ টাকা

বোতলের সয়াবিন তেলের লিটার ১৬৭, খোলা ১৪৭ টাকা

দৈনিক ইত্তেফাক
মেট্রোরেলের টিকিটে ভ্যাট না বসানোর চেষ্টা চলছে

মেট্রোরেলের টিকিটে ভ্যাট না বসানোর চেষ্টা চলছে

প্রথমআলো
বাংলাদেশ থেকে সরাসরি তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারে ব্রাজিল

বাংলাদেশ থেকে সরাসরি তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারে ব্রাজিল

বিডি প্রতিদিন
ভারতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের রেকর্ড

ভারতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের রেকর্ড

বিডি প্রতিদিন
ট্রেন্ডিং
  • ভালোবাসা দিবসে পরী মনির ‘বুকিং’

  • নির্বাচনের আগে পাকিস্তানে জোড়া বিস্ফোরণে নিহত ২৮

  • ভিসা পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে নিলো যে দেশ

  • শন্তিপূর্ণভাবে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি: প্রধানমন্ত্রী

  • ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের পারমাণবিক অস্ত্র বাড়বে তিন গুণ

  • তানজানিয়ায় প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৯

  • ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার বেশি থাকলে বেশি কর

  • কাতার বিশ্বকাপে ফিরছে জিদানের সেই ভাস্কর্য

  • ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞায় তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া

  • অবিশ্বাস্য কীর্তিতে হাজার রানের ক্লাবে এনামুল বিজয়