র‌্যাঙ্কিং, দশ টাকায় চা-শিঙ্গাড়া ও একজন ভিসি

ঘটনা আর ঘটনা। দিনান্তে এন্তার ঘটনা। একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনাকে চাপা দেয়। আমরা ভুলে যাই। গেল মাসেই সবচেয়ে মর্মান্তিক যে ঘটনা নিয়ে মানুষ বিমর্ষ আজ তা খেই হারিয়েছে। চাপা পড়েছে। সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডিতে অকালে ঝরে যাওয়া মানুষগুলোর পরিবারের সদস্যরা ন্যায়বিচার পেলো কিনা আমরা কি তার খবর রেখেছি? মিডিয়ার শিরোনামগুলো বদলে গেছে এরইমধ্যে। এসেছে কুমিল্লা সিটির নির্বাচন।

তার কেচ্ছাকাহিনী লিখতে বসে যখন কলম হাতে নিয়েছি- দাঁড়িয়েছে বৈরী প্রকৃতি। সিলেট, সুনামগঞ্জ সহ দেশের মধ্যাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ কষ্টে আছে। খেয়ে না খেয়ে, পানিতে ডুবে আছে। এরই ফাঁকফোকরে একটি ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে খুবই মন খারাপ। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত যে বিশ্ববিদ্যালয় একসময় নোবেল পদকপ্রাপ্ত উচ্চতর গবেষকদের পদচারণায় মুখর থাকতো তার অবস্থান আজ কোথায়?

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) করা জরিপ বলছে, বিশ্বসেরা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও স্থান পায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। এটি একবার বা দু’বার নয় টানা পঞ্চমবার কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে ৮০১ থেকে ১০০০তম অবস্থানে রয়েছে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়। র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক খ্যাতিতে ১৯ দশমিক ৪০, চাকরির বাজারে সুনামে ৩৪ দশমিক ২০, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে ১২ দশমিক ৯০, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতিতে ২ দশমিক ৪০, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাতে ১ দশমিক ৮০, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাতে ১ দশমিক ১০, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্কে ২৭ দশমিক ৬০ আর কর্মসংস্থানে ৫৬ দশমিক ৩০ স্কোর পেয়েছে।

‘কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিংস ২০২৩: টপ গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিস’ শীর্ষক এই র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা ৫০০-এর পরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুনির্দিষ্ট অবস্থান প্রকাশ করা হয় না। সঙ্গত কারণে এটুকু বুঝতে বাকি নেই যে, অনেক পেছনের সারিতেই আমাদের সেরা এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান। 

কিন্তু এই র‌্যাঙ্কিং প্রাপ্তিতে যতটা খারাপ অনুভব করেছি তারচেয়ে অনেক বেশি বিরক্ত এবং অসহায় বোধ করেছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির প্রতিক্রিয়ায়। যে বিশ্ববিদ্যালয় একসময় গর্ব করতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে সেই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান র‌্যাঙ্কিং আমলেই নিলেন না। উল্টো বললেন, র‌্যাঙ্কিংয়ের দিকে আমাদের কোনো অ্যাটেনশন নেই। তিনি এসব নিয়ে ভাবেন না। সাদামাটা কথায় এটুকুতো বলা যায়, স্যার আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে গৌরববোধ করতে চাই তার র‌্যাঙ্কিং নিয়ে। কারণ, র‌্যাঙ্কিং যদি নির্ভর করে গবেষণা, শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ, বিদেশি শিক্ষক, বিদেশি শিক্ষার্থী এসবের ওপর, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে তা নেই কেন? 

ইতিহাসের পাতা উল্টালে কি দেখি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে এক গৌরবজনক অধ্যায়। এর প্রথম ভিসি ছিলেন স্যার ফিলিপ হার্টগ। প্রয়াত সৈয়দ আবুল মকসুদ হার্টগকে নিয়ে লিখছেন, হার্টগ উপমহাদেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয়-সংগঠক ও শিক্ষাবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সংস্কারক ও মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে আধুনিক উচ্চতর শিক্ষার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল এই মানুষটির হাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নে হার্টগ দম্পতি তাদের ব্যক্তিগত সকল সুখ-শান্তি এক অর্থে বিসর্জন দিয়েছিলেন। হার্টগ তার কর্মকালের পাঁচবছর দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে। হার্টগের নিঃস্বার্থ ত্যাগে গড়া যে প্রতিষ্ঠান তা বহুকাল ধরেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে অস্থিচর্মসার হয়ে পড়েছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী না হতে পেরে দীর্ঘ দিবস ও রজনী নিজেও অন্তর্যন্ত্রণায় ভুগেছি। একজন বহিরাগত হিসেবে মধুর ক্যান্টিনে চা খেতে বসলে খুব অসহায় বোধ করতাম বহুকাল। মনে হতো এই প্রতিষ্ঠানের আলো-ছায়ায় বেড়ে না ওঠতে পারলে সম্ভব সবকিছু অসম্ভবের যাঁতাকলে চাপা পড়বে। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে উন্নীত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারিনি। সেই যন্ত্রণার উপশম ঘটাই মাস্টার্সের নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে দু’বছর অধ্যয়ন করে।

সবকিছুর পরও নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ইতিহাসের একজন হিসেবে গর্বিত মনে হয় বলেই র‌্যাঙ্কিং সূচকের পতনে গ্লানিবোধ করি। যে বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন আর স্বাধীনতা আন্দোলন সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়ের নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান, তা নিয়ে অহংবোধ স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যখন দেখি এই প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে তার সকল অর্জন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি আর ক্ষমতার বলয়ে থেকে টেন্ডারবাজি এই যেন তাদের পেশা। পড়ার টেবিলে আর গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে সময় নষ্ট করার মতো যথেষ্ট সময় বেশির ভাগের নেই। হল দখল, ক্যাম্পাস দখল, নেতা-নেত্রীদের গুণগান নিয়েই কাটছে সময়। শুধু ছাত্রদের দোষ দিয়ে লাভ কি? শিক্ষকরাও ব্যস্ত দলবাজিতে। কথায় আছে, যেমন রাজা তার তেমন প্রজা। দলের আস্থা বা আশীর্বাদ লাভ না করলে এখন ভিসির আসন পাওয়া যায় না। একজন ফিলিপ হার্টগকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না- এটাই চিরন্তন সত্য। কিন্তু এখানে একসময় সত্যেন বোসের মতো শিক্ষক ছিল। বুদ্ধদেব বসুর মতো ছাত্রও ছিল। লীলা নাগের মতো শিক্ষানুরাগী অধ্যয়ন করতো এখানেই। যাদের কর্মজীবন নিয়ে কোটি কোটি মানুষ গৌরব অনুভব করে। বিশ্বজোড়া যারা এই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। আর আমরা এখন কোথায় অবস্থান করছি? 

যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। কিন্তু এতটা খারাপ তা মেনে নিতে কষ্ট হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মো.  আখতারুজ্জামানের একটি বক্তব্য ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছে। বক্তৃতায় তিনি বলছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও পাবে না দশ টাকায় এক কাপ চা, একটি শিঙ্গাড়া, একটি চপ এবং একটি সমুচা পাওয়া যায়। এটি বাংলাদেশেই পাওয়া যায়। এটি যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানতে পারে তাহলে গিনিস বুকে রেকর্ড হবে। দশ টাকায় এক কাপ চা অথচ এ টাকায় এক কাপ গরম পানিও রাস্তায় পাওয়া যাবে না। দশ টাকায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে এক কাপ চা, একটি শিঙ্গাড়া, একটি সমুচা এবং একটি চপ পাওয়া যায়- এটি আমাদের গর্ব। স্যারকে বলতে চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সস্তায় চপ- শিঙ্গাড়ার চেয়ে গৌরব করার মতো, রেকর্ড করার মতো আরও অনেক বিষয় আছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় গৌরব আর অহঙ্কারের বিষয় হওয়া উচিত তার শিক্ষার মান, গবেষণার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী জোটবব্ধ হয়ে রাজনীতির নামে দিনের পর দিন শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করবে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভাগ খোলা হবে, অথচ তাতে থাকবে না যোগ্য শিক্ষক এবং পাঠদান করার মতো শিক্ষার্থীও। 

টিএসসি’র চা-শিঙ্গাড়া সস্তায় পাওয়া নিয়ে গৌরব করছেন ভিসি স্যার কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখুন শিক্ষার্থীরা কী নিয়ে ব্যস্ত। সকালে লাইব্রেরি খোলার আগেই গেটে ব্যাগ রেখে লম্বা লাইন লেগে যায় সিট রাখতে। কিন্তু এরা কেউই পঠিত বিষয় নিয়ে অধিক পড়াশোনা করতে কেউ লাইব্রেরির টেবিল দখল করে না; সকলেই টেবিল দখল করে আসছে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক পড়াশোনার জন্য। এই চিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবক’টি লাইব্রেরির। আর সাম্প্রতিক অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশকিছু এমফিল পিএইচডি’র থিসিস নিয়ে যেসব চৌর্যবৃত্তির প্রমাণ মিলেছে এটি বোধকরি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে আরও তলানিতে নিয়ে গেছে। 
এই বিভাগের আরও খবর
টাঙ্গাইলে বিদ্যালয়ে ক্লাস নিলেন উপদেষ্টা

টাঙ্গাইলে বিদ্যালয়ে ক্লাস নিলেন উপদেষ্টা

বাংলা ট্রিবিউন
পেছালো ঢাবির একটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ

পেছালো ঢাবির একটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ

দৈনিক ইত্তেফাক
লক্ষ্মীপুরে সেতু ধসে যাতায়াত বন্ধ চার দিন, বাতিল হলো একটি কলেজের পরীক্ষা

লক্ষ্মীপুরে সেতু ধসে যাতায়াত বন্ধ চার দিন, বাতিল হলো একটি কলেজের পরীক্ষা

প্রথমআলো
হলগুলোতে ছাত্রদলের পোস্টার, মধ্যরাতে ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের মিছিল

হলগুলোতে ছাত্রদলের পোস্টার, মধ্যরাতে ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের মিছিল

সমকাল
ঢাবিতে মুক্তিযুদ্ধের নাতি-নাতনির কোটা বাতিল

ঢাবিতে মুক্তিযুদ্ধের নাতি-নাতনির কোটা বাতিল

ভোরের কাগজ
এনটিআরসিএর ষষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তি আসছে, নিয়োগ হবে এক লাখ শিক্ষক

এনটিআরসিএর ষষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তি আসছে, নিয়োগ হবে এক লাখ শিক্ষক

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস
ট্রেন্ডিং
  • সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে 'বস্তায় বস্তায় ঘুষ' নেওয়ার অভিযোগ: দুদকের অনুসন্ধান শুরু

  • ভালোবাসা দিবসে পরী মনির ‘বুকিং’

  • নির্বাচনের আগে পাকিস্তানে জোড়া বিস্ফোরণে নিহত ২৮

  • ভিসা পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে নিলো যে দেশ

  • শন্তিপূর্ণভাবে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি: প্রধানমন্ত্রী

  • ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের পারমাণবিক অস্ত্র বাড়বে তিন গুণ

  • তানজানিয়ায় প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৯

  • ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার বেশি থাকলে বেশি কর

  • কাতার বিশ্বকাপে ফিরছে জিদানের সেই ভাস্কর্য

  • ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞায় তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া