অর্থনীতির শ্লথগতি ও ডলার সংকটের প্রভাবে বিপাকে পড়েছেন দেশের সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা। একদিকে সিমেন্টের চাহিদা কমেছে, অন্যদিকে ডলারের সংস্থান না হওয়ায় প্রয়োজনমতো কাঁচামাল আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। ব্যবসায় নগদ প্রবাহ কমলেও বাড়তে শুরু করেছে ব্যাংক ঋণের চাপ। এ অবস্থায় সামনের বছরগুলোয় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের গতি শ্লথ হয়ে এলে গোটা খাত বড় ধরনের বিপত্তিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত এক যুগে সিমেন্ট খাতের আকার বেড়েছে তিন গুণের মতো। সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত (বিসিএমএ) চালু সিমেন্ট কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩-এ। প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা ৮ কোটি ৫০ লাখ টন। বর্তমানে সিটি গ্রুপ, ক্রাউন সিমেন্ট, কনফিডেন্স সিমেন্ট, ইউকে বাংলা সিমেন্ট ও দুবাই-বাংলা সিমেন্টসহ আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান তাদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এতে সামনের বছর দেশের সিমেন্ট খাতের উৎপাদন সক্ষমতা ১০ কোটি টনে উন্নীত হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ভবিষ্যতের বাজার সম্ভাবনা ও চাহিদার কথা মাথায় রেখে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু ডলার সংকট ও স্থানীয় অবকাঠামো খাতে চাহিদা হ্রাস বিপাকে ফেলে দিয়েছে তাদের।
বিসিএমএর নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মেট্রোসেম সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সিমেন্ট খাতে তিন মাসের বাফার স্টক থাকে। এর মধ্যে একটি অংশ জাহাজে, একটি কারখানায় এবং আরেকটি হচ্ছে প্রস্তুতকৃত পণ্য। এটি বর্তমানে এক মাসে নেমে এসেছে। এর কারণ হচ্ছে আমরা ডলার সংকটে চাহিদামাফিক এলসি খুলতে পারছি না। ফলে ক্লিংকারসহ সিমেন্ট তৈরির অন্যান্য কাঁচামাল যেমন স্ল্যাগ, জিপসাম, লাইমস্টোন ও ফ্লাইঅ্যাশের আমদানি কমেছে। অন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা কমায় বাজারও সম্প্রসারণ হচ্ছে না। সাধারণত নভেম্বর থেকেই সিমেন্টের চাহিদা বাড়তে থাকে। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দা, ডলার সংকট ও জাতীয় নির্বাচনের কারণে এবারের মৌসুমটি ব্যতিক্রম। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফেব্রুয়ারি থেকে চাহিদা বাড়বে বলে আশা করছি। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়ে আমাদের যে লোকসান হয়েছে সেটি চলতি মূলধন থেকে উধাও হয়ে গেছে। বিষয়টি আমরা এলসি খোলার সময় গিয়ে টের পাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, ‘সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তাদের খেলাপি হওয়ার বদনাম নেই। কভিডের পর ২০২১ সালে সিমেন্ট খাত একটু ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ২০২২ ও ২০২৩ সালে এ খাত সমস্যার মধ্যে পড়েছে। বর্তমানে সিমেন্ট খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে লোকসান গোনার পাশাপাশি চলতি মূলধন সংকোচন ও ব্যাংকের অর্থ ঠিকমতো পরিশোধ করতে না পারার মতো সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোকে কেন্দ্র করে সিমেন্ট খাতে উদ্যোক্তারা তাদের সক্ষমতা বাড়িয়েছেন। আমরা মনে করেছিলাম এসব প্রকল্প চালু হলে সিমেন্টের ভোগ বেড়ে যাবে। তবে সামনের দিনগুলোয় যদি সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প সেভাবে না হয় তাহলে সিমেন্ট খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে।’
সিমেন্ট তৈরির প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার। এর পুরো চাহিদা পূরণ করতে হয় আমদানির মাধ্যমে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণকারী আমদানি পণ্যের অন্যতম ক্লিংকার। এর পাশাপাশি স্ল্যাগ, জিপসাম, লাইমস্টোন ও ফ্লাইঅ্যাশের মতো কাঁচামালও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে দেশে ক্লিংকারের আমদানি কমেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ লাখ ২৩ হাজার ৯৯২ টন বা ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দেশে ক্লিংকার আমদানি হয়েছে ৬৫ লাখ ৬৫ হাজার ৬৯৩ টন, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৭৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮৫ টন।
ক্লিংকারের আমদানি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় বাজারে চাহিদা কমায় কোম্পানিগুলোর উৎপাদনও কমেছে। পাশাপাশি কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাংকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা ভোক্তারাও নির্মাণকাজ পিছিয়ে দিচ্ছেন। আবাসন খাতে ফ্ল্যাটের বিক্রিও কমেছে। তাছাড়া আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের কারণে বর্তমানে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ক্রাউন সিমেন্ট পিএলসি মুন্সিগঞ্জে ষষ্ঠ ইউনিট নির্মাণ করছে। এ কারখানা নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ৯ কোটি ডলার। এর ৭০ শতাংশের জোগান আসবে ঋণের মাধ্যমে। জানতে চাইলে ক্রাউন সিমেন্ট পিএলসির প্রধান উপদেষ্টা মাসুদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অর্থনীতির গতি বর্তমানে শ্লথ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নির্ধারিত আয়ের মানুষেরা তাদের ব্যয়ের খাতগুলোর মধ্যে অতি প্রয়োজনীয় দিকগুলো সবার আগে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। নির্মাণ খাত অগ্রাধিকারের তালিকায় পরে আসে। এ কারণে বর্তমানে সিমেন্টের চাহিদা অনেক কম। এ বছরের জানুয়ারি-নভেম্বর পর্যন্ত এর আগের বছরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর চাহিদা কমেছে। তবে এ বছরের জুলাই থেকে চাহিদা বেশি কমেছে। সামনের বছরের ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল সময়ে চাহিদা বাড়তে পারে, তবে সেটি গত বছরের মতো নাও হতে পারে। আরেকটি দিক হচ্ছে ডলারের প্রাপ্যতার সংকটের কারণে সবাই কিন্তু ঠিকভাবে কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না। এ দুটি কারণেই মূলত সিমেন্ট উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকারের আমদানি কমে গেছে।’
বর্তমানে দেশের সিমেন্ট খাতের অর্ধেক সক্ষমতাই অব্যবহৃত রয়েছে। এ খাতে উদ্যোক্তারা ৫৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন, যার ৭০ শতাংশেরই উৎস হলো ব্যাংক ঋণ। তিন বছর আগেও এ খাতের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিসহ সক্ষমতা বাড়ানোর কারণে এ সময়ে আরো ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ বেড়েছে। দেশের সিমেন্টের বাজারে শীর্ষস্থানীয় উৎপাদকদের মধ্যে রয়েছে আবুল খায়ের গ্রুপ, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড, বসুন্ধরা গ্রুপ, সেভেন রিংস সিমেন্ট, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, কনফিডেন্স সিমেন্ট, ক্রাউন সিমেন্ট ও প্রিমিয়ার সিমেন্ট।
কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইট ও আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আবুল খায়ের গ্রুপের প্রতিষ্ঠান শাহ সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বর্তমান বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ১ কোটি টন। বসুন্ধরা গ্রুপের অধীনে দুটি সিমেন্ট কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে বসুন্ধরা সিমেন্টের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ৫০ লাখ টন। আর মেঘনা সিমেন্ট মিলসের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৩৪ লাখ টন।
বৃহৎ উৎপাদনকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেভেন রিংস সিমেন্টের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৮৪ লাখ টন। প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস পিএলসির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৮১ লাখ ১০ হাজার টন।
প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে থমকে গেছে নির্মাণকাজ। কখন এ অবস্থার পরিবর্তন হবে সেটাও অজানা। অথচ এখন নির্মাণ মৌসুম। অন্য অনেক বিষয়ের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাস পাওয়াটাই কাঁচামাল আমদানি কম হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করছি।’
লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের বার্ষিক সিমেন্ট উৎপাদন সক্ষমতা ৪১ লাখ ৯০ হাজার টন। এছাড়া কোম্পানিটির বার্ষিক ক্লিংকার উৎপাদন সক্ষমতা ১২ লাখ ৮৯ হাজার টন। হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড বছরে সিমেন্ট উৎপাদন করতে পারে ৩৫ লাখ ১০ হাজার টন। ক্রাউন সিমেন্ট পিএলসির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৩৩ লাখ ২৪ হাজার টন। কোম্পানিটির ষষ্ঠ ইউনিট উৎপাদনে এলে এর সক্ষমতা দাঁড়াবে বার্ষিক ৫৭ লাখ টনে। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৩৩ লাখ ৫০ হাজার টন। কনফিডেন্স সিমেন্ট পিএলসি বছরে সিমেন্ট উৎপাদন করতে পারে ১২ লাখ টন। আর রেডি-মিক্স উৎপাদন সক্ষমতা বছরে ২৪ লাখ টন।
কনফিডেন্স সিমেন্ট পিএলসির ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগামী ৭ জানুয়ারি দেশে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনকে ঘিরে গ্রামে-গঞ্জে মানুষ কর্মবিমুখ অবস্থায় রয়েছে। এতে ব্যক্তিগত নির্মাণকাজে শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এডিবি বাস্তবায়ন হয়েছে। ফলে সরকারি প্রকল্পেও সিমেন্টের ভোগ কমেছে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মানুষ বর্তমানে বিনিয়োগের পরিবর্তে সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকছে। সার্বিকভাবে এসব কারণে ক্লিংকারের আমদানি কমে গেছে। নির্বাচনের কারণে এবার সিমেন্টের ভরা মৌসুম একটু দেরিতে শুরু হচ্ছে। নির্বাচনের পর সরকার ও ব্যক্তি পর্যায়ে সিমেন্টের চাহিদা বাড়বে।’
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়