সিঙ্গাপুর-হংকংয়ের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার পরিকল্পনা কলম্বোর

কলম্বো উপকূলে নতুন এক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) গড়ে তুলছে শ্রীলংকা। প্রায় ৬৬৫ একর ভূমির ওপর গড়ে তোলা হচ্ছে অঞ্চলটি। এজন্য সাগরের তীরবর্তী প্রায় ২৬৯ একর পরিমাণ জমি ভরাটও করা হয়েছে। অঞ্চলটি গড়ে তুলতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৪০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। নির্মীয়মাণ অঞ্চলটির মোট আয়তন লন্ডনের মধ্যভাগের সমপরিমাণ। হংকং, সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ের সঙ্গে মিল রেখে বানানো হয়েছে অঞ্চলটির নকশা। লংকান সরকারের প্রত্যাশা, পোর্ট সিটি কলম্বো নামে গড়ে তোলা অঞ্চলটি শহরগুলোর সমকক্ষও হয়ে উঠবে।

চীনা অর্থায়নে গড়ে তোলা অঞ্চলটি নিয়ে বিতর্ক উঠেছে শুরু থেকেই। উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) প্রকল্পের অংশ হিসেবে পোর্ট সিটি কলম্বোয় বিনিয়োগ করছে বেইজিং। শ্রীলংকার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো একক দেশের সরাসরি অর্থায়নে গড়ে তোলা বৃহত্তম প্রকল্প হিসেবে তৈরি হচ্ছে অঞ্চলটি। এ অঞ্চল নির্মাণের বিরোধিতা করছেন খোদ লংকানরাই।

২২৫ সদস্যবিশিষ্ট লংকান পার্লামেন্টে চলতি মাসেই পোর্ট সিটি কলম্বোসংক্রান্ত একটি বিল পাস হয়েছে। বিলটি পার্লামেন্টের টেবিলে উত্থাপিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এর বিরোধিতা করে দায়েরকৃত ১৯টি পিটিশন খারিজ করেছেন শ্রীলংকার সর্বোচ্চ আদালত। বিলটি বাতিলের দাবি করে দায়েরকৃত এসব পিটিশনের মূল বক্তব্য ছিল—গোটা বিষয়টি শ্রীলংকার সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকি। যদিও এসব পিটিশন থেকে সামান্য সংশোধনী ছাড়া আর কিছুই আদায় করে নিতে পারেনি বিরোধিতাকারীরা। অন্যদিকে সরকারও এ সংশোধনী দ্রুত পরিপালনের ঘোষণা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, শ্রীলংকা এমনিতেই অনেক দেনার দায়ে জর্জরিত। দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো না। দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের ক্ষত এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি কলম্বো। এর মধ্যেই পরিস্থিতিকে আরো সঙিন করে তুলেছে করোনার প্রাদুর্ভাব। এ অবস্থায় এ ধরনের উচ্চাভিলাষী ব্যয়বহুল প্রকল্প শ্রীলংকাকে আরো সংকটাপন্ন অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

শ্রীলংকার বৈদেশিক ঋণের বোঝা নিয়েও নতুন করে আশঙ্কা তৈরি করেছে প্রকল্পটি। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ঋণমান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান শ্রীলংকার ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে এনেছে। স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর সম্প্রতি শ্রীলংকার ঋণমান বি-/বি থেকে সিসিসি+/সিতে নামিয়ে এনেছে। বি২ থেকে সিএএ১-এ নামিয়ে এনেছে মুডি’স। ফিচ রেটিংসে শ্রীলংকার আইডিআর রেটিং নেমে এসেছে বি থেকে সিসিসিতে। এভাবে বিভিন্ন সংস্থার ঋণমান নামিয়ে আনার বিষয়টি উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে শ্রীলংকার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যদিও শ্রীলংকার সরকার এ-সংক্রান্ত সব ধরনের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে বলছে, এসব ঋণমান সংস্থার বিশ্লেষণ অপরিপক্ব এবং এগুলোর মডেলও যথেষ্ট তথ্যনির্ভর নয়।

এ অবস্থা থেকে দ্রুতই উত্তরণের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বর্তমানে অভূতপূর্ব এক মন্দাময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলংকা। কভিডের আগে থেকেই বেশ শ্লথতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল দেশটির অর্থনীতি। ২০১৯ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্যদিকে দেশটির সরকার সম্প্রতি জানিয়েছে, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত গত বছরেই সবচেয়ে খারাপ সময় পার করেছে শ্রীলংকার অর্থনীতি। ২০২০ সালে লংকাদ্বীপের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলংকার বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। চলতি বছর এ অবস্থা থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা থাকলেও করোনার দ্বিতীয় প্রবাহ তাতেও বড় বাধার কারণ হয়ে উঠেছে। 

দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শেষে শ্রীলংকার সরকারি ঋণের পরিমাণ দেশটির মোট জিডিপিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। ২০১৯ সালে দেশটিতে ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৮৬ দশমিক ৮ শতাংশ। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০১ শতাংশে।

প্রকল্পের বিরোধিতাকারীদের বক্তব্য, চীনের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ শ্রীলংকাকে এরই মধ্যে বড় মাপের ঋণফাঁদে ফেলে দিয়েছে। সম্প্রতি চায়না মার্চেন্ট পোর্ট হোল্ডিংস কোম্পানি লিমিটেড ১২০ কোটি ডলারের বিনিময়ে ৯৯ বছরের জন্য দেশটির হাম্বানটোটা বন্দরের লিজ নিয়েছে। বলা হয়, ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে বন্দরটি ইজারায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে কলম্বো। যদিও এর অর্থ চীনের কাছ থেকে নেয়া ঋণ পুনর্গঠনের বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে রিজার্ভ হিসেবে। এ অবস্থায় চীনা অর্থায়নে নতুন করে ব্যয়বহুল এ প্রকল্প কলম্বোকে ঋণফাঁদের আরো গভীরে ঠেলে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চীন ও ভারতের মধ্যকার বৈরিতায় বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভূরাজনীতি বেশ উত্তপ্ত। ঋণফাঁদে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে কলম্বো এখান থেকে দরকষাকষির মাধ্যমে সুবিধা নেয়ার সক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলছে। উপরন্তু তা দেশটির সার্বভৌমত্বের জন্যও বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

তবে শ্রীলংকার সরকার শুরু থেকেই বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। কলম্বোর ভাষ্যমতে, এ প্রকল্প নির্মাণের চুক্তিটিকে ঋণফাঁদ হিসেবে দেখার কোনো সুযোগই নেই। দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্টে আশা প্রকাশ করে বলেছেন, পোর্ট সিটি কলম্বো আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দুই লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে। এর অধিকাংশই পাবে স্থানীয় নাগরিকরা। মূলত প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার জন্য পোর্ট সিটি কলম্বোকে গড়ে তোলা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে রাজধানী কলম্বো হয়ে উঠবে দক্ষিণ এশিয়ার আর্থিক ও সেবা খাতের বড় একটি হাব।

অন্যদিকে সি-ট্রেড মেরিটাইম নিউজকে কলম্বো পোর্ট সিটি প্রকল্পের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের পরিচালক ইয়ামুনা জয়রত্নে সম্প্রতি এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা প্রকাশ করে বলেন, ভৌগোলিক ও অবস্থানগত সুবিধার কারণে শ্রীলংকায় ব্যবসা চালানোর খরচ হংকং ও দুবাইয়ের মতো আর্থিক সেবা খাতের প্রতিষ্ঠিত হাবগুলোর চেয়েও তুলনামূলক কম।

তবে প্রকল্পের বিরোধিতাকারীরা বিষয়টিকে মেনে নিতে নারাজ। দেশটির রাজনৈতিক দল শ্রীলংকা পদুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি) এমপি ড. বিজয়দাসা রাজাপাকসে সম্প্রতি পার্লামেন্টে এ নিয়ে উত্থাপিত বিল সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, বিলটি সংবিধানের সমতাসংক্রান্ত ১২(১) ধারার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। এটি বাস্তবায়ন হলে কলম্বোর ব্যবসায়ীরা ধসে পড়বেন। নতুন এ জায়গায় বিনিয়োগকারীরা করমুক্ত সুবিধা পাবেন। বিলটি পাস হলে তাতে শ্রীলংকার অর্থনীতির কোনো লাভই হবে না। কারণ এখানে বিনিয়োগের লাভ পুরোটাই চলে যাবে চীনে। এর আগে রনিল বিক্রমাসিংহে চুক্তির ভিত্তিতে চীনকে হাম্বানটোটা বন্দর দিয়ে দিয়েছিলেন। এখন যদি একটি আইনের ভিত্তিতে পোর্ট সিটি চীনকে দিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তা হবে হাম্বানটোটা বন্দরের চেয়েও বিপজ্জনক।
এই বিভাগের আরও খবর
প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার ৫ প্রকল্প অনুমোদন একনেকের

প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার ৫ প্রকল্প অনুমোদন একনেকের

বাংলা ট্রিবিউন
রোজায় বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

রোজায় বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

যুগান্তর
এস আলমের শেয়ার বিক্রি করে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে: ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান

এস আলমের শেয়ার বিক্রি করে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে: ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান

প্রথমআলো
ব্যাংকের ওপর আস্থা কমায় টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনছে মানুষ

ব্যাংকের ওপর আস্থা কমায় টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনছে মানুষ

কালের কণ্ঠ
বিদ্যুৎ নিয়ে আদানির সাথে হওয়া চুক্তি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট

বিদ্যুৎ নিয়ে আদানির সাথে হওয়া চুক্তি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট

নয়া দিগন্ত
প্রাইম ব্যাংক ও সেবা ডট এক্সওয়াইজেডের মধ্যে চুক্তি সই

প্রাইম ব্যাংক ও সেবা ডট এক্সওয়াইজেডের মধ্যে চুক্তি সই

বাংলা ট্রিবিউন
ট্রেন্ডিং
  • সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে 'বস্তায় বস্তায় ঘুষ' নেওয়ার অভিযোগ: দুদকের অনুসন্ধান শুরু

  • ভালোবাসা দিবসে পরী মনির ‘বুকিং’

  • নির্বাচনের আগে পাকিস্তানে জোড়া বিস্ফোরণে নিহত ২৮

  • ভিসা পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে নিলো যে দেশ

  • শন্তিপূর্ণভাবে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি: প্রধানমন্ত্রী

  • ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের পারমাণবিক অস্ত্র বাড়বে তিন গুণ

  • তানজানিয়ায় প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৯

  • ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার বেশি থাকলে বেশি কর

  • কাতার বিশ্বকাপে ফিরছে জিদানের সেই ভাস্কর্য

  • ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞায় তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া