দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সরকার পতনের একদফা দাবি আদায়ে আন্দোলন করছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে বাম ও ডানপন্থি বেশ কয়েকটি দল। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ভোটার উপস্থিতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করতে নানা কৌশল নিয়ে ভোটের হিসাব কষছে। তারই অংশ হিসেবে ২৯৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি। তবে তারা যেন বিনাভোটে জয়ী হয়ে না যান সেই কৌশল হিসেবে দলের সামর্থ্যবান নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার নির্দেশনা রয়েছে হাইকমান্ড থেকে। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও প্রায় সব আসনে এককভাবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। বসে নেই ‘কিংস পার্টি’ খ্যাত ছোট দলগুলো। জোটগত কিংবা এককভাবে তারাও ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের পরামর্শেই দলগুলো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে জানা গেছে। এদিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন আজ।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার জাতীয় নির্বাচনটি ২০১৪ সালের চেয়ে আলাদাভাবে আয়োজন করতে চাইছে সরকার। এর মূলে রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর নানা শর্ত এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার তাগিদ এবং ভিসা নীতি প্রয়োগসহ নানা রকম নিষেধাজ্ঞার ভয়। ফলে বিএনপি ভোটে না এলেও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে ছোট দলগুলোকে বড় ভূমিকায় নিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী কৌশল হিসেবে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছাড়াও দলটির নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে ইসি গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সংসদ সদস্যদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পদত্যাগ করতে হবে না। তবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ অনুযায়ী, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে হলে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন সংবলিত স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। তবে কোনো প্রার্থী এর আগে জাতীয় সংসদের কোনো নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকলে সেটির প্রয়োজন নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির পাশাপাশি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে জাকের পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোট ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট। বীর প্রতীক মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী দিচ্ছে মোট ১০০ আসনে। এ জোটে নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মতিন)। এছাড়া জাতীয় পার্টি (জেপি) ৫০, গণতন্ত্রী পার্টি ৩৫, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ২২৫, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ৯, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ১৮০, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ১২০, গণফ্রন্ট ৫০, ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ ৭০, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ১০০, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি ১৫০টি আসনে নির্বাচনে প্রস্তুতি নিয়েছে।
ভোটে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে নিজেদের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারাও। তারা অবশ্য ঠিক কয়টি আসনে প্রার্থী দেবে সে সংখ্যা প্রকাশ করেনি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) জোটগতভাবে ভোট করবে বলে ইসিকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল। তবে দলগুলো এককভাবেও নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা দল থেকে এখন পর্যন্ত ১৮০টি আসনে প্রার্থী নির্ধারণ করেছি। তবে জোটগতভাবে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য শিগগিরই বৈঠক করা হবে।’
আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে এরই মধ্যে শরিকদের আসনে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সমঝোতা হলে পুরনো আসনগুলো ছেড়ে দেয়া হবে, নাকি নতুন আসনে ছাড় দেয়া হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসন বণ্টন আসলে পরস্পর সমঝোতার বিষয়। সবচেয়ে গুরুত্বের বিষয় হচ্ছে, আপনি নির্বাচনে জেতার মতো কিনা? শরিক সে জন্য দেব? কিন্তু আপনাকে তো নির্বাচনে জিততে হবে। সেটা নাম্বার ওয়ান।’
প্রার্থী জয়ী হতে পারবে কিনা, সেটি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘শরিক হলেই তাকে নমিনেশন দেয়া হবে না। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার যোগ্য প্রার্থী না হলে শুধু শরিক বলেই কাউকে মনোনয়ন দেবে না আওয়ামী লীগ।’
নির্বাচন বর্জন করে বিএনপির চলমান কর্মসূচি প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তারা হরতাল ডাকছে কার বিরুদ্ধে, এটা তো নির্বাচনের বিরুদ্ধে; নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য এসব কর্মকাণ্ড করছে। আজকে যারা মানবাধিকারের কথা বলে, বাংলাদেশে সুশাসনের কথা বলে, যারা ফ্রি ফেয়ার নির্বাচনের কথা বড় গলায় বলে, তারা আজকে একটা পক্ষের এসব অপকর্ম, গণতন্ত্রবিরোধী, সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কেন নীরব? এটা নিয়ে তো কেউ কিছু বলছে না। নির্বাচনকে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, যারা বাধা দিচ্ছে, তাদের ব্যাপারে তারা কেন নীরব? আমাদের দেশে যারা সুশীল সমাজ যারা মানবাধিকারের কথা বলে, তাদের কাছে আমার এ প্রশ্ন।’
নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে ইসির নিবন্ধিত ৪৪টি দলের সঙ্গেই যোগাযোগ করে বণিক বার্তা। এর মধ্যে ১৭টি দল নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কথা জানিয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠন এবং তাদের ঘোষিত তফসিলকে ‘অবৈধ’ ও ‘একতরফা’ দাবি করে তারা ভোট বর্জনের এ ঘোষণা দিয়েছে। দলগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ), ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস।
নির্বাচন কমিশন একতরফা তফসিল ঘোষণা করেছে দাবি করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রিত্বে থাকবেন, তার নেতৃত্বের সরকার থাকবে আর অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে, এটা ডাহা ভণ্ডামি ও মেকি। জাতি মনে করছে, এর মধ্য দিয়ে সিইসি জাতির সঙ্গে মশকরা করেছেন। অতীতের মতো আরেকটি প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার হরণের জন্য মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন যে তফসিল ঘোষণা করেছে, তা আমরা চরম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।’
নতুন নিবন্ধন পাওয়া দল ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে দলটির মহাসচিব মো. রেহান আফজাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা সংসদ বিলোপসহ চারটি দাবি জানিয়েছি নির্বাচন কমিশনের কাছে। আমাদের দাবির বিষয়ে লিখিত আবেদনও দিয়েছি। কিন্তু তারা সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা মনে করি এ পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’
নির্বাচনে প্রার্থী করা নিয়ে জাতীয় পার্টিতেও মনোমালিন্য দেখা দিয়েছে। দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ গতকাল রাতে ঢাকার গুলশানের বাসায় তার অনুসারীদের নিয়ে এক বৈঠক করেন। এরপর তিনি এবারের নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেন। এরশাদপত্নির অভিযোগ, জাতীয় পার্টি দলের নেতাদের অবমূল্যায়ন করেছে। এ কারণেই তিনি নির্বাচন করবেন না। রওশন এরশাদ মূলত ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনে নির্বাচন করেন। সে আসনটি তার জন্য খালি রেখেছে দল।
এদিকে নির্বাচনের তফসিল পেছানোর জন্য বেশ কয়েকটি দলের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বৈঠক করলেও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ বিষয়ে কমিশনের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, তফসিল পেছানোর আবেদনের বিষয়ে চার নির্বাচন কমিশনার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে আলোচনার পর এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি তারা। আজ সকাল পর্যন্ত হয়তো সময় নেবে কমিশন। যদি সময় বাড়ানোও হয় আগামী রোববার পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায় পশ্চিমা দেশগুলো। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলিসহ ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। পরে চার্লস হোয়াইটলি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত মতবিনিময় হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তার টিম খোলামেলা আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে জেনেছি। আমরা আশা করি গণতান্ত্রিক, গ্রহণযোগ্য ও অংগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। পুরো বিশ্বও এটি দেখতে চায়।’
অন্যদিকে বৈঠকের বিষয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘তারা দীর্ঘ সময় আমাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে জেনেছেন। আমাদের প্রস্তুতিটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এটা তারা জানতেন না। আমাদের অগ্রগতিগুলো তাদের জানিয়েছি। আমরা আগের মতোই স্পষ্ট করে তাদের জানিয়েছি যে, আমরা অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়