স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের সময় দেশগুলোর সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখা দেয় বাণিজ্যিক সুবিধা হারানো। এর ধারাবাহিকতায় তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হন রফতানিকারকরা। বাধাগ্রস্ত হয় রফতানি। শুল্ক বাধাও জোরালো হয়ে ওঠে। উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের পথে শুল্ক সুবিধা বঞ্চিত হলে বাংলাদেশকেও মাশুল হিসেবে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়তি খরচ করতে হবে। তাই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আসন্ন ১২তম মিনিস্টারিয়াল সম্মেলনে ২০২৬ সালের পর থেকে আরো নয় বছরের শুল্কমুক্ত সুবিধা চাইবে বাংলাদেশ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
৩০ নভেম্ব্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বাংলাদেশও অংশ নেবে। ওই সম্মেলনের প্রস্তুতি সভা হিসেবে ৪ ও ৫ নভেম্বর দুই দিনব্যাপী ভার্চুয়াল বৈঠক করেছে বাংলাদেশ। ডব্লিউটিওর সব সদস্য দেশ ও ৪৭টি স্বল্পোন্নত দেশের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রটি জানিয়েছে, ভার্চুয়াল এ সভায় এলডিসি থেকে উত্তরণের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও এলডিসি উত্তরণের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কিত একটি প্রেজেন্টেশনও উপস্থাপন করা হয়। মূল বৈঠকে যেসব প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে, মূলত সেগুলো নিয়েই আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের দাবিগুলোর বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো। এ সম্মেলনের অভিজ্ঞতা ও আগের অভিজ্ঞতার আলোকে চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বাংলাদেশ একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই সেটি চূড়ান্ত করা হবে।
খসড়ায় বাংলাদেশ মূলত তিনটি বড় বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। পাশাপাশি অমীমাংসিত অনেক বিষয় দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূত্রটি বলছে, খাতভিত্তিক প্রয়োজনীয় বাণিজ্য সুবিধা ন্যূনতম ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বহাল রাখার দাবি করবে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালের পর ছয় বছর পুরোপুরি শুল্ক সুবিধা ও তার পরের তিন বছর পর্যালোচনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে শুল্ক সুবিধা বহাল রাখতে হবে। কৃষি ও মত্স্য খাতের ভর্তুকি কীভাবে বহাল রাখা যায়, সে বিষয়গুলো নিয়ে অলোচনা করা হবে। এ খাতে নিয়োজিত কৃষক ও জেলেদের উন্নয়নে ভর্তুকি সুবিধা যাতে চলমান থাকে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতের বর্তমানের রফতানি যেভাবে চলছে, সেটি বজায় রেখে আরো বাড়তি সুবিধা কীভাবে আদায় করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি ডব্লিউটিওর সংস্কারও চাওয়া হবে। এছাড়া বাংলাদেশের জন্য রুলস অব অরিজিন শিথিল করার বিষয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হবে। সেবা খাতের রফতানির জন্য ৫২টি দেশ এরই মধ্যে অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু সেই অনুমোদন বাস্তবিক অর্থে কোনো কাজে আসছে না। ফলে সেটির সুবিধা যেন বাংলাদেশসহ এলডিসি দেশগুলো পেতে পারে তার দাবি জানানো হবে। এছাড়া দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়েও চেষ্টা চালাবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের এসব দাবির বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া রয়েছে স্বয়ং ডব্লিউটিওর। সম্প্রতি প্রকাশিত ট্রেড ইম্প্যাক্টস অব এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রফতানিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, সেটি পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ২০১৬-১৮ সালের রফতানি বাণিজ্য বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৪৩ কোটি ডলারের সুবিধা ভোগ করেছে। রফতানি প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় নিয়ে সেটি ৩০০ কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে। বর্তমান সময়ের বিবেচনায় সেটি প্রায় ২৭০ কোটি ডলার। ফলে এ সুবিধা উঠে গেলে বাংলাদেশকে কমপক্ষে ২৩ হাজার কোটি টাকার বাড়তি শুল্ক দিতে হতে পারে। এছাড়া মোট রফতানি প্রায় ১৪ শতাংশ কমে যেতে পারে। ফলে রফতানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে ৫০০ কোটি ডলার।
তাই স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ তাদের বিভিন্ন দাবিকে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সামনে উত্থাপন করবে। আসন্ন এ সম্মেলনে এলডিসির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাণিজ্য বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চার সদস্যের দলের নেতৃত্ব দেবেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। দলে থাকবেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ, মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান। এছাড়া জেনেভা থেকে বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিও এ দলে যুক্ত হবেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধাগুলো যেকোনো দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্ব্বী করতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এসব সুবিধা বাংলাদেশ আদৌ পাবে কিনা বা পেলে কতদিনের জন্য পাবে, কী ধরনের সুবিধা পাবে এসব বিষয় নিয়ে নানা ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। সেটি দূর করতে বাংলাদেশকে যৌক্তিকভাবে তাদের দাবি উপস্থাপন করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, বাণিজ্য সুবিধার পাশাপাশি ও অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। এজন্য সব বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ আলোচনায় নেতৃত্ব দেবে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পরও বিনা শুল্কে রফতানি সুবিধা চালু থাকার ব্যাপারে বাংলাদেশ বরাবরই আশাবাদী। এ সুবিধার সময়সীমা বাড়াতে ডব্লিউটিওর সঙ্গে আলোচনা করেই একটি টেকসই সমাধানের চেষ্টা করবে।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা ছাড়াও কম সুদে বিদেশী ঋণ ও কিছু ক্ষেত্রে অনুদান পেয়ে থাকে। এ তালিকায় বাংলাদেশসহ মোট ৪৭টি দেশ রয়েছে। ওষুধ উৎপাদনে মেধাস্বত্ব থেকেও অব্যাহতি পেয়ে আসছে বাংলাদেশ। ওষুধের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলো এ সুবিধা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত পাবে। কিন্তু এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এসব সুবিধা আর থাকবে না। ফলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়বে। পাশাপাশি রফতানি বাজার নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশী পণ্যের ওপর গড়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ শুল্ক বাড়বে। ফলে বাংলাদেশকে বছরে ২৫০ কোটি ডলারের বেশি শুল্ক রাজস্ব দিতে হতে পারে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়