জমির খরচ বাদ দিয়ে শুধু অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে কভিডপূর্ব কালে ভবনের প্রতি বর্গফুটে ব্যয় হতো ১ হাজার ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ও নির্মাণ খাতসংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, নির্মাণসামগ্রী ও উপকরণের দাম বাড়ায় এখন ব্যয় বাড়লেও তা সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় নির্মাণ করতে গিয়ে এরই মধ্যে বর্গফুটপ্রতি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭৩২ টাকায়। ২০০৯ সালে শুরুর পর এখনো শেষ করা যায়নি ভবনটির নির্মাণকাজ। বরং অর্থাভাবে ভবনটির নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে ২০২১ সালের মে মাস থেকে।
ভবনটি নির্মাণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছিল ১৯৫ কোটি টাকা। যদিও এরই মধ্যে ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫২৩ কোটি টাকায়। প্রধান কার্যালয়ের ভবন নির্মাণে অনুমোদনের চেয়ে আড়াই গুণেরও বেশি ব্যয়কে অস্বাভাবিক বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কয়েক দফায় ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে। তার পরও ন্যাশনাল ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরো অর্থ ব্যয়ের অনুমোদন চাওয়া হয়। এ অবস্থায় পরামর্শ ও নির্দেশ পরিপালন না করার দায়ে ব্যাংকটিকে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যানুযায়ী, শুরুতেই ভবনটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। প্রতি বর্গফুট ৫ হাজার টাকা করে মোট ধরা হয়েছিল ১৭৭ কোটি টাকা। যদিও এরই মধ্যে ভবনটির প্রতি বর্গফুট নির্মাণে নিজের নির্ধারিত ব্যয়ের প্রায় তিন গুণ খরচ করে ফেলেছে ব্যাংকটি।
ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ভবন নির্মাণের এ ব্যয়কে অস্বাভাবিক বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কয়েক দফা ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়। তার পরও ন্যাশনাল ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরো অর্থ ব্যয়ের অনুমোদন চাওয়া হয়। এ অবস্থায় পরামর্শ ও নির্দেশ পরিপালন না করার জন্য ব্যাংকটিকে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নির্মাণ প্রকৌশলী ও আবাসন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মাণ উপকরণের দাম বাড়ার আগে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ভবন নির্মাণে ব্যয় হতো ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকার মতো। আর দাম বাড়ার পর প্রতি বর্গফুট ভবনের মৌলিক কাঠামো নির্মাণে সর্বোচ্চ ব্যয় হতো ৩ হাজার টাকা। ভবনে ভূমিকম্প সহনশীলতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলতেও এর চেয়ে বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয় বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কভিড সংক্রমণের আগে বহুতল ভবনের মৌলিক কাঠামো তৈরিতে প্রতি বর্গফুটে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা ব্যয় হতো। এখন নির্মাণ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ ব্যয় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। কোনো ভবন নির্মাণে যদি এর চেয়ে বেশি ব্যয় হয়, তাহলে সেখানে অপব্যয় ও দুর্নীতি হয়েছে বলে মনে করার অবকাশ থাকে।’
প্রধান কার্যালয়ের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকের নির্মাণাধীন ভবনটির অবস্থান রাজধানীর কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারার পশ্চিম পাশে। নিজস্ব জমিতে তিন বেজমেন্টসহ ১২ তলাবিশিষ্ট পাশাপাশি দুটি ভবনের নাম দেয়া হয়েছে ‘টুইন টাওয়ার’। মোট ফ্লোর স্পেসের আয়তন নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৫৫ হাজার বর্গফুট। এর মধ্যে একটি ভবনে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় হলেও অন্যটিতে আবাসিক হোটেল করার প্রস্তাব করেছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকের টাকায় আবাসিক হোটেল নির্মাণের প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছিল।
ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিচালনা পর্ষদের যোগসাজশে শুরুতেই ভবন নির্মাণের অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হয়েছিল। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ভবনের মৌলিক কাঠামোই দাঁড়ায়নি। যদিও এরই মধ্যে ব্যয় হয়ে গিয়েছে ৫২৩ কোটি টাকা। অথচ এ বিনিয়োগের কোনো রিটার্ন নেই, বরং ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় পরিচালিত হচ্ছে পরিচালকদের মালিকানাধীন ভবনে উচ্চমূল্যে ভাড়া পরিশোধ করে। প্রতি মাসে শুধু প্রধান কার্যালয়ের ভাড়া বাবদ ব্যাংকটির ব্যয় হচ্ছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মেহমুদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রধান কার্যালয়ের ভবন নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে এক যুগেরও আগে। আর আমি এ ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে যোগ দিয়েছি ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। অতীতে ভবন নির্মাণের ত্রুটিবিচ্যুতি হয়ে থাকলে সেটি আমার জানার কথা নয়।’
তিনি বলেন, ‘প্রধান কার্যালয়ের ভবন নির্মাণ ব্যয় বর্ধিত করে ৫২৮ কোটি টাকা অনুমোদনের জন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন জানিয়েছিলাম। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে আবেদনে সাড়া দেয়নি। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত ভবন নির্মাণে ৫২৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যয় অনুমোদন করলে আমরা নতুন করে নির্মাণকাজ শুরু করব।’
ন্যাশনাল ব্যাংকের টুইন টাওয়ার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০৯ সালে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে দরকষাকষি ও কয়েক দফায় নকশা সংশোধনের পর এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের মে মাসে। ন্যাশনাল ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভবনটি নির্মাণে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান হিরিম আর্কিটেক্টস অ্যান্ড প্ল্যানারস কোম্পানি লিমিটেডকে (এইচএপিসিএল) পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছিল। কোম্পানিটির পক্ষ থেকে ডং আহ কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানি লিমিটেড ও মাম ইমপ্লেক্সকে সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগ দেয়া হয়। মাম ইমপ্লেক্সের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নির্মাণকাজ শুরুর পর ২০১৫ সালের ২৭ মে ভবনটির বেজমেন্ট, শোর পাইলিংসহ বিভিন্ন অংশ ধসে পড়ে। এ ঘটনায় টুইন টাওয়ারের নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে মাম ইমপ্লেক্সের নিয়োগ করা ঠিকাদার সিটিস্ক্যাপ ২০১৭ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে আবারো শোর পাইলিংয়ের কাজ শুরু করে। ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ভবনটির নির্মাণ ব্যয় ৫২৮ কোটি টাকা করার প্রস্তাব পাস হয়। যদিও ব্যাংকটির সে প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দেয়নি। ন্যাশনাল ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত চিঠির জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ভবনের নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক। একই সঙ্গে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংককে নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপর আবারো ব্যয় বৃদ্ধির আবেদন জানালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকটিকে সতর্ক করা হয়।
ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ভবন নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত পক্ষগুলোর মধ্যে হিরিম আর্কিটেক্টস অ্যান্ড প্ল্যানার্স কোম্পানি লিমিটেডকে ২৮ কোটি, ডং আহ কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানিকে ৩ কোটি ও মাম ইমপ্লেক্সকে ৬০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। ২০১৫ সালে নির্মাণাধীন ভবনটি ধসে পড়ার আগ পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যয় ছিল ৯১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে আবারো নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর মাম ইমপ্লেক্সকে ১২৩ কোটি ৪৩ লাখ, সিটিস্কেপ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে ২৯৮ কোটি ২১ লাখ, আবুল খায়ের স্টিল (একেএস) মিলকে ৩ কোটি ৭৮ লাখ ও ডমরপুর কংক্রিট রেডি মিক্স প্লান্টকে ৬ কোটি ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ধসে যাওয়া-পরবর্তী এ খাতে ব্যাংকটির ব্যয় হয়েছে ৪৩১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
গত এক যুগে টুইন টাওয়ারের চারটি বেজমেন্ট, টাওয়ার-১-এর ১২ তলা পর্যন্ত ছাদ, টাওয়ার-২-এর ১১ তলার ছাদ, লিফট কোর ও সিঁড়ি নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে বলে ন্যাশনাল ব্যাংক জানিয়েছে। ব্যাংকটির তথ্যমতে, এখনো টাওয়ার-২-এর ১২ তলার ছাদ ঢালাই, ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল ওয়ার্ক, বাহির ও অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, কাচের আচ্ছাদন, প্লাম্বিং ও স্যানিটারি, ইলেক্ট্রিক্যাল ওয়ার্ক, বৈদ্যুতিক সংযোগ, র্যাম্প ঢালাই, ল্যান্ড স্কেপিং, অভ্যন্তরীণ রাস্তা এবং বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ বাকি রয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভবনটি এখনো যে অবস্থায় আছে, তাতে পূর্ণাঙ্গ করতে আরো ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। সেটি হলে নির্মাণ ব্যয়ের দিক থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের টুইন টাওয়ার রেকর্ড তৈরি করবে।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক এমডি মেহমুদ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভবনের বাকি কাজ সম্পন্ন করতে কত ব্যয় হবে, সেটি আমার জানা নেই। বিশেষজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে ভবিষ্যৎ ব্যয়ের বাজেট নির্ধারণ করা হবে।’
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়