দীর্ঘ চার দশকের যুদ্ধে জর্জরিত আফগানিস্তান। এ চার দশকে দেশটিতে যুদ্ধ চালিয়ে জয় পায়নি বিশ্বের বড় বড় শক্তির কোনোটিই। দুই দশক ধরে বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় ও প্রাণহানির পর বিষয়টি অনুধাবন করছে যুক্তরাষ্ট্রও। আফগানিস্তানে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে পরাজয়ের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে ওয়াশিংটন। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জেন সাকি সম্প্রতি বলেছেন, আফগানিস্তানে যে যুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও তা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে তালেবানদের সাম্প্রতিক বিজয় আন্তর্জাতিক মহলকে এরই মধ্যে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘও। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে কাবুল সরকারও। তবে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠায় রয়েছে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলো। তালেবানরা ক্ষমতায় এলে বড় ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোর অধিকাংশই।
তালেবান হুমকি নিয়ে কথা বলতে বর্তমানে সপ্তাহব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। আলোচনায় বসেছেন মার্কিন কংগ্রেসের প্রভাবশালী সিনেটর ও পেন্টাগনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে। কিছুটা সাফল্যও পেয়েছেন। বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সিনেটর এরই মধ্যে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছেন।
এসব আলোচনায় অনেকটা কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন আফগান প্রেসিডেন্ট। তিনি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে তিনি সম্মান জানান। আবার হোয়াইট হাউজকে কাবুলকে বিপন্ন অবস্থায় রেখে পরিত্যাগ করছে, এমন কোনো বক্তব্যেও তিনি বিশ্বাস করেন না। তবে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখন সংকটাপন্ন। একা অবস্থায় তার পক্ষে তালেবানদের মোকাবেলা করা মুশকিল।
আশরাফ ঘানির এমন বক্তব্যের কিছু সুফলও মিলেছে। এরই মধ্যে কয়েকজন রিপাবলিকান সিনেটর জো বাইডেনের প্রতি মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন না। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জেন সাকিও বলেছেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন। তিনি বুঝতে পারছেন এ যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। এ কারণে তিনি মার্কিন সেনাদের দেশে ফিরিয়ে আনছেন।
তবে সেনা প্রত্যাহার করে নিলেও যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে মানবিক ও নিরাপত্তা সহায়তা বজায় রাখবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে মার্কিনদের এ সহায়তা গ্রহণের জন্য কাবুলের বর্তমান সরকার টিকে থাকবে কিনা, সে বিষয়ে সন্দিগ্ধ সবাই। কারণ জেন সাকি ক্যাপিটল হিলে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার দিনেই ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ছয় মাসের মধ্যে কাবুলের দখল নিয়ে নিতে পারে তালেবানরা।
তালেবানদের এ অগ্রযাত্রা দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের তোলপাড় ফেলে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তালেবানদের বিজয় আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ভূরাজনৈতিক গঠনে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসার জোর সম্ভাবনা রয়েছে।
আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেসব দেশকে ছায়াযুদ্ধে নামিয়ে দিতে পারে তার মধ্যে যেমন ইরান রয়েছে, তেমনি রয়েছে দুই চিরবৈরী পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত-পাকিস্তানও। এ খেলায় শামিল হতে পারে আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বের দেশ চীন এবং মধ্য এশিয়ার জ্বালানি তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ দেশগুলোও।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেতে গতকালই এক নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নানা কারণেই যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের সঙ্গে এসব দেশের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। হিন্দুকুশ পর্বতমালা বিধৌত অঞ্চলটি থেকে পশ্চিমা সেনা প্রত্যাহারের কারণে তাদের সবার সক্রিয় বিষয়টিতেও তাই আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই।
আফগান অ্যানালাইসিস নেটওয়ার্কের বিশ্লেষক থমাস রাটিগের বরাত দিয়ে নিবন্ধে বলা হয়, আফগানিস্তানে অদূরভবিষ্যতে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থ পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ। ফলে দেশগুলোর কোনো কোনোটি এরই মধ্যে আফগানিস্তানের মাটিতে দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সংঘাত ও উত্তেজনার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের কথা। আঞ্চলিক রাজনীতিতে কাবুল সরকারের অন্যতম প্রধান মিত্র ভারত। নয়াদিল্লি শুরু থেকেই তালেবানদের নিজ নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখে এসেছে। কাশ্মীরভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে যোগসাজশও নয়াদিল্লিতে তালেবানদের নিয়ে এক ধরনের ভীতি তৈরি করেছে।
অন্যদিকে তালেবানদের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করলেও বিষয়টি নিয়ে ইসলামাবাদের অবস্থানকে বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। থমাস রাটিগের মতে, আফগানিস্তানকেন্দ্রিক ভূরাজনীতির খেলায় তালেবানরা হলো পাকিস্তানের হাতের সর্বশ্রেষ্ঠ কার্ড। ইসলামাবাদ বরাবরই আফগানিস্তানকে দেখেছে নিজের পেছনের আঙিনা হিসেবে। দেশটির শাসন ব্যবস্থায়ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর পাকিস্তান। এ কারণে আফগানিস্তান ইস্যুতে পাকিস্তানের সদিচ্ছার ওপর ভরসা না রাখাই উত্তম।
এছাড়া বর্তমানে এ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাব্য ক্ষেত্র হিসেবে পাকিস্তানের কথাও বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে এখন জোর বিতর্ক চলছে ওয়াশিংটনে। মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে দিলে পাকিস্তানের আঞ্চলিক প্রতিপত্তি বাড়ার সম্ভাবনাও দেখতে পাচ্ছেন অনেকেই। যদিও ইসলামাবাদ দাবি করেছে, নিজ ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাঁটি করতে দেয়ার কোনো ইচ্ছা পাকিস্তানের নেই। যদিও গত মাসের শেষ নাগাদ এক বিবৃতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোকে মার্কিন ঘাঁটি স্থাপন করতে দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে তালেবানরা।
অন্যদিকে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি প্রত্যাহারের বিষয়টিকে অনেকটা মিশ্র দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে বেইজিং। নিজ সীমানার কাছাকাছি মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি চীনের জন্য কখনই সুখকর নয়। আবার এ মার্কিন সেনারাই এতদিন চীনের নিরাপত্তা হুমকি তালেবানদের উত্থানকে ঠেকিয়ে রেখেছে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়