আফগান শরণার্থীই এখন পাকিস্তানের জ্যাকপট

ইউরোপে পণ্য রফতানিতে জিএসপি প্লাস সুবিধা চায় পাকিস্তান। একই সঙ্গে মুদ্রাপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি, মহামারীকালীন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ সংস্থাকে মহাদেশটিতে পুনরায় প্রবেশের অনুমতি দেয়াসহ ইউরোপের দেশগুলোর কাছ থেকে আরো অনেক সুবিধা নিতে চাইছে ইসলামাবাদ। আর দেশটি এসব সুবিধা আদায় করতে চাইছে শুধু আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার বিনিময়ে। অন্যদিকে বিপাকে পড়া ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষে এখন চাইলেও এসব দাবি পূরণে অস্বীকৃতি জানানোটা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের জন্য কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক অনেক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে তালেবানদের কাবুল দখল। দেশত্যাগী আফগান শরণার্থীদের ঢল ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) এখন সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে পাকিস্তানের ওপর। এর সুবাদে ইইউর কাছ থেকে যথাসম্ভব বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিতে চাইছে দেশটি। যদিও শরণার্থীদের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে অর্থসহায়তাও পেতে যাচ্ছে পাকিস্তান।

গত কয়েক দশকের সংঘাতে বাস্তুচ্যুত অনেক আফগান এরই মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। সর্বশেষ তালেবানদের কাবুল দখলের পর আফগানদের মধ্যে দেশত্যাগের হিড়িক দেখা দেয়। ন্যাটো জোটের সহায়তায় অনেক আফগান উদ্বাস্তু এরই মধ্যে আকাশপথে দেশত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছে। যারা পারেনি, তাদের বড় একটি অংশ এখন ভিড় জমাচ্ছে পাকিস্তান ও তাজিকিস্তান সীমান্তে। ইইউর আশঙ্কা, অদূরভবিষ্যতে আশ্রয় ও অভিবাসনের জন্য ইউরোপের দিকে পা বাড়াবে এ আফগান শরণার্থীরা। সেক্ষেত্রে মহাদেশীয় রাষ্ট্রজোটটির সদস্যদেশগুলোকে নতুন করে রাজনৈতিক ও মানবিক সংকটের মোকাবেলা করতে হতে পারে।

তালেবানদের কাবুল দখলের পর থেকে ইউরোপীয় দেশগুলো এখন পর্যন্ত নিজ নিজ কূটনীতিকদের অনেককেই সরিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে সম্ভাব্য শরণার্থী সংকট নিয়ে নতুন করে চিন্তিত হয়ে পড়েছে দেশগুলো। এ দুই সংকট মোকাবেলার জন্য ইইউকে এখন পাকিস্তানের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

কাবুলের পতনের এক সপ্তাহের মধ্যেই জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা পাকিস্তান সফরে গিয়েছেন। আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য পাকিস্তানকে নগদ সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাদের সবাই। একই সঙ্গে নিজ নিজ দেশের কূটনীতিক ও আফগানিস্তানে নিযুক্ত দূতাবাসের স্থানীয় কর্মীদের সেখান থেকে বের করে আনায় সহযোগিতা করার জন্যও পাকিস্তানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তারা।

তবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, নিছক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নয়, তাদের পাকিস্তান ভ্রমণের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় পাকিস্তানের সহায়তা পাওয়ার পথ পরিষ্কার করা। ইউরোপমুখী শরণার্থীর ঢল শুরু হওয়ার আগে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোতেই তা থামিয়ে দিতে চাইছেন তারা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে পাকিস্তান।

লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম এফটি জানাচ্ছে, যেকোনো মূল্যে ২০১৫ সালের সিরীয় শরণার্থী সংকটের পুনরাবৃত্তি এড়াতে চাইছে ইইউ। এজন্য মহাদেশীয় জোটটির কর্তাব্যক্তিরা এরই মধ্যে এ নিয়ে ৬০ কোটি ইউরোর একটি প্রস্তাব প্যাকেজের খসড়া তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য হলো পাকিস্তানসহ আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলো যাতে শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। 

অন্যদিকে এক কূটনৈতিক নোটের বরাত দিয়ে ব্লুমবার্গ ও কাতারভিত্তিক আল-জাজিরা জানাচ্ছে, আসন্ন ঢল এড়াতে মহাদেশটির অভ্যন্তরে অবস্থানরত ৩০ হাজার আফগান শরণার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য ৩০ কোটি ইউরোর আরেকটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে ইইউর নির্বাহী সংস্থা ইউরোপীয় কমিশন (ইসি)। গত ২৬ আগস্ট আফগানিস্তান নিয়ে ইইউর রাষ্ট্রদূতদের এক বৈঠকে এ পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। পরিকল্পনায় প্রয়োজনে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়ার কথাও বলা হয়েছে।

কূটনৈতিক নোটে আরো বলা হয়, ইইউর দেশগুলোয় অভিবাসীদের মিছিল ঠেকাতে পাকিস্তান ও তাজিকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোয় উন্নয়ন সহযোগিতার দিকে মনোযোগ দেবে মহাদেশীয় রাষ্ট্রজোটটি। এক্ষেত্রে পাকিস্তান ও তাজিকিস্তানের মতো আফগানদের অভিবাসনের ট্রানজিট হিসেবে চিহ্নিত দেশগুলো গুরুত্ব পাবে সবচেয়ে বেশি।

এ বিষয়ে পর্যবেক্ষকদের অভিমত হলো, ইইউ এখন যেকোনো মূল্যে ২০১৫ সালের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে চাইছে। জোটের শীর্ষ নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোও সেদিকেই নির্দেশ করছে। ইইউতে বর্তমানে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছে স্লোভেনিয়া। দেশটির প্রধানমন্ত্রী জানেজ জ্যানসা সম্প্রতি এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ইইউর পক্ষে এখন কোনোভাবেই আফগানদের জন্য মানবিক অভিবাসনের পথ খুলে দেয়া ঠিক হবে না। খুলে দিলে তা হবে ২০১৫ সালের কৌশলগত ভুলের পুনরাবৃত্তি।

ওই সময় উদ্বাস্তু সংকট প্রকট হয়ে দেখা দিলে তা ইইউর সদস্যদেশগুলোর মধ্যকার বিরোধেরও কারণ হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ব্যাপক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে এক পর্যায়ে সংকট মোকাবেলার জন্য তুরস্কের দ্বারস্থ হয় ইইউ। আঙ্কারাকে প্রচুর অর্থসহায়তা দেয়া হয়, যাতে তুরস্ক শরণার্থীদের ইইউভুক্ত দেশগুলোয় যেতে দেয়ার বদলে নিজেই গ্রহণ করে।

পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও একই কৌশল হাতে নিয়েছে ইইউ। ব্রাসেলস অনুধাবন করতে পারছে, পাকিস্তানের সহায়তা ছাড়া আসন্ন উদ্বাস্তু সংকট মোকাবেলা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ইইউর এ নাজুক অবস্থান ইসলামাবাদও বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নিতে চাইছে ইমরান খানের সরকার।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইসলামাবাদ এখন এদিক থেকে সবচেয়ে বড় সুবিধা নিতে যাচ্ছে ভূরাজনৈতিকভাবে। কিছুদিন আগেও চীনকে মোকাবেলার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইইউভুক্ত দেশগুলো দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বড় মিত্র হিসেবে বিবেচনা করেছে ভারতকে। অন্যদিকে পাকিস্তান হয়ে পড়েছিল পুরোপুরি উপেক্ষিত। এ অঞ্চলে জোটটির কাছ থেকে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সুবিধার দাবিদার হয়ে উঠেছিল ভারত। সর্বশেষ গত মে মাসেও নয়াদিল্লির সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিল ব্রাসেলস।

কিন্তু কাবুলের পতনের পর গোটা চিত্রই বদলে যায়। পাকিস্তান ফিরে আসে দৃশ্যপটে। বর্তমানে আফগান শরণার্থীদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল পাকিস্তান। বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সহায়তা, বাণিজ্যিক ও ভ্রমণ সুবিধা এবং কাশ্মীরের বিরোধপূর্ণ অঞ্চল নিয়ে ইউরোপীয়দের সমর্থন আদায় করতে চাইছে ইসলামাবাদ। এছাড়া বিষয়টিকে কাজে লাগাচ্ছে ইউরোপে নিজের হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রেও।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোমিনিক রাব তার সফরকালে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশির সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সে সময় শাহ মাহমুদ কুরেশি ডোমিনিক রাবের কাছে পাকিস্তানকে যুক্তরাজ্যের ‘লাল তালিকা’ থেকে বের করে আনার দাবি তোলেন। এ তালিকার ভিত্তিতে পাকিস্তানের ওপর মহামারীকালীন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাজ্য। সে সময় এ চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন রাব। বর্তমানে বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানি ও ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে।

ওই সময়ে মুদ্রাপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের ‘ধূসর তালিকা’ থেকে পাকিস্তানকে বের করে আনার বিষয়েও ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সহযোগিতা চান শাহ মাহমুদ কুরেশি। এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাবমূর্তির সংকটে পড়ার পাশাপাশি ঋণ পাওয়াও পাকিস্তানের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল।

এছাড়া বর্তমানে ইইউভুক্ত দেশগুলোর কাছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে জিএসপি প্লাস সুবিধাও চাইছে পাকিস্তান। এর সুবিধা পেলে স্বল্প বা বিনাশুল্কে ইউরোপে পণ্য রফতানি করতে পারবে পাকিস্তান। শিশুশ্রম, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগের কারণে এতদিন পাকিস্তানকে এ সুবিধা দেয়া থেকে বিরত থেকেছে ইইউ।
এই বিভাগের আরও খবর
যে কারণে পাকিস্তানকে নিষেধাজ্ঞার হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের

যে কারণে পাকিস্তানকে নিষেধাজ্ঞার হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের

জনকণ্ঠ
ইউক্রেনের ৫০ ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি রাশিয়ার

ইউক্রেনের ৫০ ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি রাশিয়ার

ভোরের কাগজ
আন্তর্জাতিক নির্দেশিকাকে লঙ্ঘন করে শিশুখাদ্যে চিনি মেশাচ্ছে নেসলে

আন্তর্জাতিক নির্দেশিকাকে লঙ্ঘন করে শিশুখাদ্যে চিনি মেশাচ্ছে নেসলে

মানবজমিন
ইরানের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো

ইরানের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো

কালের কণ্ঠ
রেকর্ড বৃষ্টিপাতে বিপর্যস্ত আমিরাত, ওমানে ভারি বর্ষণে নিহত ১৮

রেকর্ড বৃষ্টিপাতে বিপর্যস্ত আমিরাত, ওমানে ভারি বর্ষণে নিহত ১৮

যুগান্তর
ইসরাইলে হামলার পর ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ'র নতুন নিষেধাজ্ঞা, কী বলছে রাশিয়া

ইসরাইলে হামলার পর ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ'র নতুন নিষেধাজ্ঞা, কী বলছে রাশিয়া

নয়া দিগন্ত
ট্রেন্ডিং
  • ভালোবাসা দিবসে পরী মনির ‘বুকিং’

  • নির্বাচনের আগে পাকিস্তানে জোড়া বিস্ফোরণে নিহত ২৮

  • ভিসা পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে নিলো যে দেশ

  • শন্তিপূর্ণভাবে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি: প্রধানমন্ত্রী

  • ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের পারমাণবিক অস্ত্র বাড়বে তিন গুণ

  • তানজানিয়ায় প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত ১৯

  • ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার বেশি থাকলে বেশি কর

  • কাতার বিশ্বকাপে ফিরছে জিদানের সেই ভাস্কর্য

  • ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞায় তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া

  • অবিশ্বাস্য কীর্তিতে হাজার রানের ক্লাবে এনামুল বিজয়