বিশ্ববাজারে ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থমূল্যের পণ্য গত অর্থবছরে রফতানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে, যার প্রায় ৮২ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। আবার রফতানি হওয়া পণ্যের ৬৪ দশমিক ৬১ শতাংশই গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। একক পণ্য ও দুটি গন্তব্যের ওপর নির্ভরতা এখন বড় ধরনের অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে দেশের রফতানিকারকদের। কারণ বাংলাদেশী পোশাকের প্রচলিত বাজারগুলো এখন অর্থনৈতিক মন্দায় প্রবেশ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, দেশের পোশাক খাত টেকসই করতে নতুন গন্তব্য দরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের এক্সটার্নাল ইকোনমিকস শাখা থেকে নিয়মিতভাবে প্রকাশ পায় তৈরি পোশাকের প্রান্তিক পর্যালোচনা শীর্ষক প্রতিবেদন, যার জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২২-২৩ সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে চলতি সপ্তাহে। প্রতিবেদনটিতে নতুন রফতানি গন্তব্যের বিষয়টিতে জোর দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়, দেশের অর্থনীতির অন্যতম অবলম্বন তৈরি পোশাক এখন মন্থর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে ২০২১-২২ অর্থবছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের চেয়ে রফতানি কমেছে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। বেড়েছে জীবনযাপনের ব্যয়। প্রধান রফতানি গন্তব্যগুলোর জনগোষ্ঠী বাধ্য হচ্ছে পোশাক কেনা বাবদ ব্যয় কমিয়ে আনতে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে বৈশ্বিক গ্যাস সংকট, ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি, আর্থিক নিয়মনীতির কড়াকড়ি এবং বিশ্বব্যাপী ডলারের মূল্য আরো বৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে। এতে পোশাক খাতের গতি শ্লথ হতে পারে। পোশাকের প্রধান রফতানি গন্তব্য দেশগুলোতে বর্তমানে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। তাই জাপান, ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো প্রতিশ্রুতিশীল এশীয় অর্থনীতির দেশই হওয়া উচিত বাংলাদেশের গন্তব্য নির্ধারণের নতুন লক্ষ্য। পাশাপাশি কৃত্রিম তন্তু বা ম্যান মেড ফাইবার এবং কারিগরি বস্ত্রের বৈশ্বিক বাজারের বৈচিত্র্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংস্থাটির মতে, তুলাজাত তৈরি পোশাকের চেয়ে কৃত্রিম তন্তুজাত পোশাক রফতানিতে লাভবান হওয়ার সুযোগ বেশি।
দেশের তৈরি পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন গন্তব্যগুলোতে এরই মধ্যে রফতানির গতি ভালো। বিশেষ করে বর্তমান খারাপ সময়েও ভারতে রফতানি পরিস্থিতি ভালো এবং বাড়ছে। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়াতেও রফতানি বাড়াতে কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। দেশটিতে এখন রফতানি বাড়ছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে পোশাক রফতানি বৃদ্ধিতেও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ১০০ ক্রেতা প্রতিনিধি। তারাও বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি বৃদ্ধিতে আগ্রহী। বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমেও রফতানি বাজার প্রসারিত করার উদ্যোগ চলমান রয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা নতুন দেশগুলোর দিকে মনোযোগী হচ্ছি। কারণ নিজেরাই বুঝতে পারছি, ইউরোপে মন্দা ও মূল্যস্ফীতির কারণে সামনের দিনগুলোতে রফতানি শ্লথ হবে। যুক্তরাষ্ট্রেও শ্লথ হতে পারে, যদিও দেশটিতে এখন পর্যন্ত রফতানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। তবে জ্বালানি সংকট, তেলের দাম ও সরবরাহের জন্য ইউরোপে শ্লথগতি থাকবে এটা নিশ্চিত। সামগ্রিক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নতুন বাজারগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। সরকারের সমর্থন বাড়ানো প্রয়োজন। নতুন বাজারে রফতানি বাড়ানোর জন্য ৪ শতাংশ প্রণোদনা আছে, এটা ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করলে রফতানিকারকদের উৎসাহ বাড়বে। আবার নন-কটন পণ্যে প্রণোদনা চেয়েছি আমরা। এখনো কোনো ফল পাইনি। এটা হলে প্রচলিত বাজারগুলো সম্প্রসারণের পাশাপাশি নতুন বাজার ধরা সহজ হবে।
বাজার বৈচিত্র্যকরণে চ্যালেঞ্জের বিষয়ে ফারুক হাসান বলেন, বাজারের পাশাপাশি তৈরি পোশাকের মধ্যেই বৈচিত্র্য আনার প্রচেষ্টা রয়েছে আমাদের। ম্যান মেড ফাইবার পণ্যের বাজার অনেক বড়। এ বাজার ধরতে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু শুল্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ধরনের পণ্য নিয়ে রয়েছে নানাবিধ জটিলতা। এসব জটিলতা নিরসন হলে পণ্য ও বাজার দুদিক থেকেই বৈচিত্র্যকরণ নিশ্চিত করা সহজ হবে।
প্রান্তিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রফতানি সহজতর করার জন্য বেশকিছু ব্যবস্থা নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট সুবিধা। করোনা মহামারীর মধ্যে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। উদ্যোক্তারা এ তহবিল থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে ৬ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারেন। সম্প্রতি রফতানি খাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের সুদহার গ্রহীতা পর্যায়ে ৬ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যাংক পর্যায়ে ৩ থেকে ২ শতাংশে নামিয়েছে। এ পুনঃঅর্থায়ন প্রকল্পের আওতায় উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ সুবিধার মেয়াদ এক বছর থেকে বাড়িয়ে তিন বছর করা হয়েছে। উদ্যোক্তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একাধিকবার ঋণ পেতে পারেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রদত্ত আরেকটি সুবিধার মধ্যে আছে রফতানি সম্প্রসারণের জন্য প্রণোদনা। এর মধ্যে রফতানি পণ্যে ৪ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। বিদ্যমান ৪ শতাংশ নগদ প্রণোদনা থাকা সত্ত্বেও ইউরো জোনে পোশাক রফতানিকারকদের সহায়তা হিসেবে অতিরিক্ত ২ শতাংশ প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। আবার ১ শতাংশ বিশেষ নগদ প্রণোদনা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া বস্ত্র ও পোশাক খাতের সংগঠনগুলোর সদস্য মিলগুলোর জন্য রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সীমা ২ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি ডলারে উন্নীত করা হয়েছে।
নীতিনির্ধারকরাও বলছেন, সার্বিকভাবে মূল সমস্যা হলো বাংলাদেশের রফতানি খাতে পর্যাপ্ত পণ্য না থাকা। প্রধান পণ্য পোশাক। পণ্যটি বৈচিত্র্যকরণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে উৎপাদন করতে না পারাও সংকটের অন্যতম কারণ। এখন পশ্চিমা বাজারগুলো অর্থনৈতিক মন্দায় চলে গিয়েছে। পোশাক ক্রয়ে ব্যয় একেবারেই কমে এসেছে। ক্রেতাদের আর্থিক দায় বেড়েছে। খাদ্যশস্যের দামও বেড়ে গিয়েছে। আগে পোশাক ক্রয়ে যে ধরনের ব্যয় সক্ষমতা ছিল, সেটিও এখন ঘাটতির দিকে। তবে পণ্যে কেন্দ্রীভবনের সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকার ও খাতসংশ্লিষ্টরা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বণিক বার্তাকে বলেন, রফতানি পণ্যে কেন্দ্রীভবনের সমস্যা থেকে উত্তরণ রাতারাতি হবে না। এখন এ বিষয়ে কিছু কাজ হচ্ছে। কিন্তু অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গিয়েছে। শিল্পোদ্যোক্তারা যেদিকে লাভ দেখেন, সেদিকেই মনোনিবেশ করেন। আমাদের বেশির ভাগ বিনিয়োগ রফতানির ক্ষেত্র হচ্ছে পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্ট। আর দেশের অভ্যন্তরে হলে সেটা দেখা যাচ্ছে খাদ্যপণ্য-সংশ্লিষ্ট। বিনিয়োগেও বৈচিত্র্য আনতে হবে। সর্বোপরি আমাদের পণ্যে বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। মান অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি দক্ষতাও বাড়াতে হবে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়