গোটা বিশ্বেই বার্মা টিক বা মিয়ানমারে উৎপাদিত সেগুন কাঠের জনপ্রিয়তা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় একটি উৎস সেগুন কাঠ। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে দেশটির ওপর নানা মাত্রার অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) পশ্চিমা দেশগুলো। এসব বিধিনিষেধেও জনপ্রিয়তা কমছে না বার্মা টিকের। খোদ অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপকারী দেশগুলোয়ই এখন পণ্যটির আমদানি বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ফরেস্ট ট্রেন্ডসের এক হিসাব অনুযায়ী, মিয়ানমার থেকে রফতানীকৃত কাঠের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই যাচ্ছে দেশটির ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখা পশ্চিমা দেশগুলোয়।
বার্মা টিকের রফতানি কার্যক্রমকে একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত মিয়ানমার টিম্বার এন্টারপ্রাইজ (এমটিই)। এমটিইর মতো সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোও এর আওতাধীন। বিধিনিষেধের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে নানা উপায়ে সেগুন কাঠ সংগ্রহ করেছে পশ্চিমা আমদানিকারকরা।
ফরেস্ট ট্রেন্ডসের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মিয়ানমার থেকে প্রায় ১৯ কোটি ১০ লাখ ডলারের (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ হাজার ৬৭১ কোটি টাকারও বেশি) কাঠ রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে বিধিনিষেধ আরোপকারী পশ্চিমা দেশগুলোয় রফতানি
হয়েছে ৩ কোটি ডলারের কাঠ, যা ৭০ লাখ পণ্যটির মোট রফতানির ১৯ শতাংশেরও বেশি। শুধু ইইউ অঞ্চলের দেশগুলোই আমদানি করেছে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ ডলারের কাঠ। আঞ্চলিক জোটের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও পোল্যান্ড আগের বছরের একই সময়সীমার চেয়ে আমদানি বাড়িয়েছে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে আগের বছরের দুই-তৃতীয়াংশ। যদিও মোট কাঠ বাণিজ্য বেড়েছে সামান্য।
মার্কিন আমদানিকারকরা মিয়ানমার থেকে মূলত চেরা সেগুন কাঠ সংগ্রহ করে থাকে, যা বিলাসবহুল ইয়ট তৈরিতে ব্যবহার হয়। জাস্টিস ফর মিয়ানমার (জেএফএম) নামে একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ অভিযোগ তুলেছিল, বিধিনিষেধের শিথিল প্রয়োগের কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলো মিয়ানমার থেকে কাঠ আমদানির সুযোগ পাচ্ছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো মিয়ানমার থেকে ৮২টি চালানে ১ হাজার ৬০০ টন সেগুন কাঠ আমদানি করেছে। এক্ষেত্রে বিধিনিষেধের জাল এড়াতে প্রতিষ্ঠানগুলো দালালদের সহায়তা নিয়েছে। এক্ষেত্রে দালালরা শুরুতে এমটিইর কাছ থেকে নিলামে কাঠ কিনে নেয়। তারপর কাঠগুলো সরাসরি অথবা চীনের মতো কোনো দেশ ঘুরে চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রে।
পর্যবেক্ষকদের অভিযোগ, এমটিই তাতমাদোর (বর্মি সামরিক বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম) সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকায় প্রতিষ্ঠানটির নিলাম কার্যক্রম এখন বেশ অস্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত এমটিইর কাঠ ব্যবসা থেকে আয়সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। যদিও ইন্টারন্যাশনাল ট্রপিক্যাল টিম্বার অর্গানাইজেশন (আইটিটিও) গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে এমটিইর পাঁচটি নিলামের তথ্য পেয়েছে। এ পাঁচ নিলাম থেকেই এমটিইর আয় হয়েছে ৮১ লাখ ডলারের বেশি। তবে এসব নিলামে ওঠা কাঠের কোনোটিই রফতানিযোগ্য মানের ছিল না।
ফরেস্ট ট্রেন্ডসের ফরেস্ট পলিসি, ট্রেড অ্যান্ড ফাইন্যান্স ইনিশিয়েটিভের সিনিয়র ডিরেক্টর কারস্টিন ক্যানবির উদ্ধৃতি দিয়ে পরিবেশ ও জ্বালানিবিষয়ক সংবাদমাধ্যম মঙ্গা বে জানিয়েছে, মিয়ানমারের সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকস অর্গানাইজেশন (সিএসও) ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ৬ কোটি ডলারের বনজ সম্পদ রফতানির তথ্য জানিয়েছে। যদিও আমদানিকারক দেশগুলোর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, তারা ১৯ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের কাঠ আমদানি করেছে, যার অর্ধেকেরও বেশি গিয়েছে চীনে। সে হিসেবে হয় অবৈধ পন্থায় এ বাণিজ্য সম্পাদন হয়েছে অথবা সিএসও এ তথ্য চেপে গিয়েছে।
কারস্টিন ক্যানবি আরো জানান, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রফতানীকৃত কাঠের উৎস সম্পর্কেও কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। সে হিসেবে এ কাঠ অভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী সরকারি মজুদ থেকে রফতানি করা হয়েছে নাকি জান্তার আটককৃত মজুদ বা নতুন সংগ্রহ থেকে রফতানি করা হয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য দেয়া যাচ্ছে না।
ফরেস্ট ট্রেন্ডসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে মিয়ানমার থেকে বিধিনিষেধ না দেয়া দেশগুলো সেগুন কাঠ আমদানি করেছে ১৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। এর মধ্যে চীন একাই আমদানি করেছে ৯ কোটি ২০ লাখ ডলারের কাঠ। আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ভারত। দেশটি গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে মিয়ানমার থেকে ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের সেগুন কাঠ আমদানি করেছে। থাইল্যান্ড আমদানি করেছে দেড় কোটি লাখ ডলারের। এছাড়া এ তালিকার উল্লেখযোগ্য অন্যান্য দেশ হলো জাপান (১৯ লাখ ডলার), অস্ট্রেলিয়া (১৭ লাখ ডলার), ভিয়েতনাম (৭ লাখ ডলার) ও নিউজিল্যান্ড (৬ লাখ ডলার)।
মিয়ানমারের সঙ্গে সেগুন কাঠ বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপাকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে অনেক। ফরেস্ট ট্রেন্ডসের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউএস ল্যাসি অ্যাক্ট ও ইইউ টিম্বার রেগুলেশনের (ইইউটিআর) আইনের ধারাগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে অবৈধ উৎস থেকে কাঠ আমদানির পথ পুরোপুরি রুদ্ধ হয়ে পড়ার কথা। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে মিয়ানমার থেকে সেগুন কাঠ আমদানি করার দায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় ধরনের দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। একই সঙ্গে তারা আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতেও অভিযুক্ত হতে পারে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়