পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দেশে নেই। আশির দশকের পর থেকে সরকারের পছন্দে ও দলীয়করণের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া। উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগও একইভাবে হচ্ছে। অনেক সময় অসৎ ও অযোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে সরকারও বিপাকে পড়ে। তাই সার্চ কমিটির মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন অনেক শিক্ষাবিদ।
দেশের পুরোনো ও বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। সেখানে সিনেটে উপাচার্য নিয়োগের প্যানেল নির্বাচনের বিধান আছে। এ বিধান অনুসারে সিনেট সদস্যদের ভোটে উপাচার্য পদের জন্য তিনজনের প্যানেল নির্বাচিত হয়। নির্বাচিতদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর যে কোনো একজনকে নিয়োগ দেন। তবে এই চার বিশ্ববিদ্যালয়েও অনির্বাচিত উপাচার্যের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। অনির্বাচিত অনেকে আবার অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পেয়ে চার বছরের পুরো মেয়াদ পার করে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দিয়েছেন, যাতে তাকে আবার নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে।
এ চারটি বাদে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারের সরাসরি পছন্দে উপাচার্য নিয়োগ করা হচ্ছে। এ পদে আসীন হয়ে কেউ কেউ অনিয়ম ও দুর্নীতির জালে জড়িয়ে দুর্নাম কামিয়েছেন। আবার কেউ কেউ প্রশাসনিক অযোগ্যতারও পরিচয় দিয়েছেন। কাউকে কাউকে মেয়াদ ফুরনোর আগেই বিদায় নিতে হয়েছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, কেবল দলীয় বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ করায় নানা সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। একাডেমিক স্কলার ও প্রশাসনিক দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং সততার অতীত ট্র্যাক রেকর্ড না দেখে উপাচার্য নিয়োগ করায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায়ই নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।
তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নীল, সাদা, গোলাপি রংয়ের নানা ধারায় বিভক্ত। তাদের এ বিভক্তির ঢেউ ছাত্রদের মধ্যেও আছড়ে পড়ছে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া প্রায় সব উপাচার্যই নিজ নিজ ক্যাম্পাসে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এতেও সংকট বাড়ে। তাই উপাচার্য নিয়োগের একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও বিধান থাকা প্রয়োজন। সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমেও উপাচার্য নিয়োগ করা যেতে পারে।
সম্প্রতি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে অনশন করেন শিক্ষার্থীরা। তারা এখনও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এরপরই উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে সুধীসমাজে আলোচনা শুরু হয়েছে। সঠিক ব্যক্তিকে নির্বাচন করতে না পারায় বর্তমান সরকারের গত ১৩ বছরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন ছয়জন উপাচার্য। এ পরিস্থিতিতে উপাচার্য নিয়োগে সরকারকে আরও সতর্ক হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।
রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বা আচার্য। আইন অনুযায়ী তিনি উপাচার্যদের নিয়োগ দিলেও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চ্যান্সেলরের সাচিবিক দপ্তর হিসেবে কাজ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। এখানেই নাম প্রস্তাব করে সরকারপ্রধানের অনুমোদন নিয়ে নথি চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানো হয়। তিনজনের নামের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একজনের নাম অনুমোদন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নথি পাঠালে নিয়োগের আদেশ জারি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় দলীয়করণের সুযোগ পুরোটাই। মূলত সরকারের পছন্দের ব্যক্তির নামই নথিতে উত্থাপিত হয়।
বারবার অশান্ত ক্যাম্পাস: কয়েকজন উপাচার্যের প্রশাসনিক অদক্ষতায় বিগত দিনে অশান্ত হয়ে উঠেছে একাধিক ক্যাম্পাস। ২০২০ সালে জাহাঙ্গীরনগরে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন চলেছে টানা দু'মাস। গত বছর শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের চুল কেটে দেওয়ার ঘটনায় ফুঁসে ওঠেন ছাত্ররা। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) একটি হলের প্রভোস্টকে মানসিক নির্যাতনের পর তার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠায় আন্দোলনে নামেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া হল চালুর দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তবে সব ঘটনাকে পেছনে ফেলেছে শাবিপ্রবির আন্দোলন।
এর আগে নানা কারণে কয়েক উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালে পদত্যাগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এসএমএ ফায়েজ। ২০১২ সালে ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক এস এম নজরুল ইসলাম ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির পদত্যাগ করেন ২০১২ সালে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক উপাচার্য আনোয়ার হোসেনও পদ ছাড়তে বাধ্য হন ২০১৪ সালে। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিন আহমেদ ২০১৯ সালে এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম ইমামুল হক একই বছর পদত্যাগ করেন।
দ্বিতীয় মেয়াদে অনিয়ম বেশি: অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যরা তাদের শেষ মেয়াদে বেশি প্রশাসনিক অনিয়মে জড়িয়েছেন। গত বছর পাঁচজন ভিসি তাদের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করেন।
সবার বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তারা অনেকটাই বেপরোয়া ছিলেন।
গত বছর ৬ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে অধ্যাপক আব্দুস সোবহান ১৪১ জনের হাতে অস্থায়ী (অ্যাডহক) নিয়োগ দিয়ে তিনি কড়া পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করে তার মেয়ে এবং জামাতাসহ ৪৩ জনকে নিয়োগ দেন। তাদের ৩৪ জনেরই শিক্ষক হওয়ার কোনো যোগ্যতা ছিল না।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপাচার্য অধ্যাপক এম এ মাননান গত বছরের ২৩ মার্চ তার দ্বিতীয় মেয়াদ পূর্ণ করেন। এ মেয়াদের পুরো সময়ই নিয়োগ ও কেনাকাটায় তিনি ছিলেন বেপরোয়া। তার ছেলে জাহেদ মাননান ২০১৬ সালে বাউবিতে সহকারী অধ্যাপক পদে আবেদন করলে নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকায় আবেদন বাতিল হয়। কিন্তু এক বছর পার হওয়া মাত্রই ২০১৮ সালে তার ওই ছেলেই সহযোগী অধ্যাপক পদ বাগিয়ে নেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. ফায়েক উজ্জামান গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করেন। ওই মাসেই তিনি ১২৬ জনকে নিয়োগ দিয়ে যান। গত বছরের মার্চে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমানের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হয়।
শিক্ষাবিদদের পরামর্শ: শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। এগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতিও রয়েছে। এ ছাড়া বড় বড় কাজের টেন্ডার তো আছেই। তিনি বলেন, এক মেয়াদের বেশি উপাচার্য পদে কাউকে রাখা সমীচীন নয়। এতে এই পদের প্রত্যাশীরা বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়াদের বিরুদ্ধে ইন্ধন জোগান। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, অনেকেই উপাচার্য পদে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেন, যা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সুখকর নয়। এ জন্য উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া খুব স্বচ্ছ হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ প্যানেল করা যেতে পারে। তারা দেখে উপাচার্য নিয়োগের সুপারিশ করবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, উপাচার্যদের হতে হবে নিরপেক্ষ। একইসঙ্গে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে দক্ষ ও যোগ্য লোককে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।
উপাচার্য নিয়োগে আরও সতর্ক হতে সরকারকে পরামর্শ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ জন্য আমি মনে করি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আরও সতর্ক হতে হবে।
ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, সরকার যোগ্য লোককে যোগ্য জায়গায় বসাতে পারছে না বলেই উপাচার্যদের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। উপাচার্য নিয়োগ যাচ্ছেতাইভাবে হতে পারে না। তিনি বলেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে। এ রীতি আমাদের পাশের দেশ ভারতেও আছে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়