লাদাখ সীমান্তে অচলাবস্থা কাটিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছিল চীন-ভারত। উভয় পক্ষের মধ্যে এ নিয়ে চুক্তিও হয়েছিল। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি আবারো বদলাতে শুরু করেছে। লাদাখে চীন-ভারত সীমান্তের পশ্চিম সেক্টরে সামরিক তত্পরতা বাড়াচ্ছে উভয় দেশই। চীন এরই মধ্যে সীমান্তে মোতায়েনকৃত সৈন্যের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলেছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে আরো সৈন্য সমাবেশের। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও জানিয়েছে, এজন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন সৈন্যদের প্রস্তুত করা হচ্ছে। অন্যদিকে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে ভারতও। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে উঠে এসেছে, লাদাখ সীমান্তে মোতায়েনকৃত সৈন্যের সংখ্যা অন্তত আরো অর্ধ লাখ বাড়িয়ে তুলতে যাচ্ছে নয়াদিল্লি।
এতদিন পর্যন্ত বেইজিং ও নয়াদিল্লি জোর গলায় দাবি করে এসেছে, সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনের প্রয়াস চালানো হচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুই দেশের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে এক বিশেষ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সে সময় উভয় পক্ষই হিমালয়ের বিরোধপূর্ণ অঞ্চল থেকে মোতায়েনকৃত সৈন্য প্রত্যাহারের ইঙ্গিত দিয়েছিল। একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানেরও ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতেও ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ভারতীয় পার্লামেন্টে বলেছিলেন, দুই দেশের সামরিক ও কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের কয়েক দফা আলোচনার পর দুই দেশ সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছে।
তবে পরিস্থিতি আবার উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠার ইঙ্গিত পাওয়া যায় গত সপ্তাহে। কাতার ইকোনমিক ফোরামে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখতে গিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর সীমান্তে চীন সৈন্য সমাবেশ বাড়িয়ে তুলছে বলে অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে আমাদের সামনে দুটি বড় ইস্যু রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো এখনো সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় সেনা সমাবেশ বাড়ছে, বিশেষ করে লাদাখে। প্রশ্ন হলো, চীন তার কথা রাখবে কিনা। দুই দেশের পক্ষ থেকেই সীমান্তে বড় মাত্রায় সেনা মোতায়েন করা হবে না বলে লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এর চেয়েও বড় বিষয় হলো আমরা পারস্পরিক সংবেদনশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ ও স্বার্থের ভিত্তিতে এ সম্পর্ক তৈরি করতে পারি কিনা।
এর দুদিনের মাথায় বুধবার সীমান্তে নতুন করে সৈন্য সমাবেশের বিষয়ে মুখ খোলে বেইজিং। ওই সময়ে বেইজিংয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান দাবি করেছিলেন, ‘সংশ্লিষ্ট দেশের’ সম্ভাব্য আগ্রাসন ও হুমকি মোকাবেলায় সাধারণ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে চীন-ভারত সীমান্তে মোতায়েনকৃত সৈন্যের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে।
এর পরদিনই বিষয়টি নিয়ে আবারো অভিযোগ তোলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বলেন, চীন আবারো লাদাখ সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ রেখার (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি) কাছাকাছি বিপুল পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ করছে। এর মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির শর্ত ও সীমান্তের শান্তি লঙ্ঘন করছে বেইজিং।
একই দিনে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, লাদাখের পাহাড়ি অঞ্চলে লড়াইয়ের জন্য দেশটির সেনাবাহিনী চলতি বছরে এখন পর্যন্ত শতাধিক যৌথ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করেছে। পিপলস লিবারেশন আর্মির ২০টি ইউনিটের কমপক্ষে সহস্রাধিক সৈন্য এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে।
চীনা সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রেন গুয়োচিয়াং ওইদিন এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, কভিড-১৯ মহামারী সত্ত্বেও ভূপৃষ্ঠ থেকে রেকর্ড উচ্চতায় সৈন্যদের এ বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোনের দক্ষ ব্যবহারও এ প্রশিক্ষণের অংশ ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল সীমান্তে মোতায়েনকৃত সৈন্যদের চরম ঠাণ্ডা, প্রতিকূল ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশেও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দক্ষতা তৈরি করা। নিয়মিত সামরিক বাহিনী ও মিলিশিয়া ইউনিটের সদস্যদের একযোগে এ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় আগে থেকেই এয়ারফিল্ড ও বিমানঘাঁটিসহ বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা গড়ে তুলছিল বেইজিং।
বেইজিংয়ের এসব পদক্ষেপকে যুদ্ধ প্রস্তুতি হিসেবেই দেখছে ভারত। দেশটি বর্তমানে এ নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। পাশাপাশি রক্ষণাত্মক খোলস থেকে বেরিয়ে যুদ্ধংদেহী অবস্থানে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে দেশটি। ভারত এরই মধ্যে চীন সীমান্তের দিকে অন্তত ৫০ হাজার সৈন্য সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এতদিন পর্যন্ত চীনকে মোকাবেলায় মোটামুটি রক্ষণাত্মক ভঙ্গিমায় ছিল ভারত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সে খোলস থেকে বেরিয়ে আসার কথা চিন্তাভাবনা করছে দেশটি। এজন্য অন্তত ৫০ হাজার সৈন্যকে চীন সীমান্তের দিকে রওনা করিয়ে দিয়েছে নয়াদিল্লি।
এছাড়া শুধু চীন নয়, ভারতও সীমান্তে মোতায়েনকৃত সৈন্যের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলেছে। মার্কিন একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, বর্তমানে চীন সীমান্তে মোতায়েনকৃত ভারতীয় সৈন্যের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। গত বছরের তুলনায় মোতায়েনকৃত ভারতীয় সেনার সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এ পর্যন্ত সীমান্তে দেশটির সামরিক কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল শুধু চীনের আগ্রাসন মোকাবেলাতেই। তবে এখন প্রয়োজনে আক্রমণে যাওয়ার কথাও ভাবছে দেশটি। এজন্য সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা সমাবেশে মনোযোগ দিয়েছে ভারত।
চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বৈরিতা শুধু সামরিক নয়, পরিবর্তন এনেছে ভারতের ভূরাজনৈতিক অবস্থানে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি শীর্ষ পর্যায় এতদিন প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে এসেছে পাকিস্তানকে। নয়াদিল্লির যাবতীয় সামরিক কৌশলেরও কেন্দ্রবিন্দু ছিল পাকিস্তান। তবে চীনের সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে নয়াদিল্লির সে অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক উত্তেজনা অনেকটাই কমিয়ে এনেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। এর পরিবর্তে নয়াদিল্লির যাবতীয় মনোযোগ এখন কেন্দ্রীভূত হয়েছে বেইজিংয়ে।
পাকিস্তান সীমান্তেও এখন মোতায়েনকৃত সৈন্যের সংখ্যা কমিয়ে এনেছে ভারত। এসব সৈন্যকে স্থানান্তর করা হচ্ছে চীন সীমান্তে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, পাকিস্তান সীমান্তে সন্ত্রাসবিরোধী তত্পরতায় নিয়োজিত ২০ হাজার সৈন্যকে লাদাখে চীন সীমান্তে নিয়ে এসেছে ভারত। এছাড়া চীন সীমান্তের কাছাকাছি মোতায়েন করা হচ্ছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর কয়েক স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমানও।
ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং চলতি সপ্তাহেই লাদাখে চীন সীমান্তে যুদ্ধ প্রস্তুতি পরিদর্শন করে এসেছেন। দেশটির সেনাপ্রধান মনোজ মুকুন্দ নাভারানেসহ জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের অনেকেই এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। চীনকে মোকাবেলায় দেশটির নৌবাহিনীও এখন অনেক বেশি তত্পর হয়ে উঠেছে বলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে উঠে এসেছে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়