শক্তিশালী সেনাবাহিনী, প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ ও বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি—সব মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বৈশ্বিক পরাশক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সময়ের চাহিদা দেশটির এ অবস্থান তৈরি করেছে। নিজস্ব মূল্যবোধের বিশ্বায়ন, স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করে যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য অর্জনে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আইনের প্রয়োগ ক্ষেত্রবিশেষে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়। প্রয়োজনে দেয়া হয় নিষেধাজ্ঞার হুমকিও। বৈশ্বিক রিজার্ভে ডলারের মর্যাদা যুক্তরাষ্ট্রকে অসামান্য প্রভাবশালী করে তুলেছে। বিদেশী তহবিল আটকে দেয়া ও নিজেদের পুঁজিবাজারে প্রবেশগম্যতা সীমিতকরণের পাশাপাশি মুদ্রানীতির মাধ্যমেও বৈশ্বিক প্রভাব তৈরি করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
গত শতকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার শক্তিও খর্ব হয়। যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়াকে দেখে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে, বিশ্ব পরাশক্তি হিসেবে নয়। স্নায়ুযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্র এবিএম (অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল) এবং আইএনএফের (ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্স) মতো অনেক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিকে বাতিল করে দিয়েছে। এটাকে দীর্ঘমেয়াদে কৌশলগত সমতা হিসেবে দেখা যায় না।
মার্কিন শক্তির প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের পরই চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি। একই সঙ্গে দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ ও বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎপাদনের কেন্দ্র। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্যবসায়িক সঙ্গীও চীন। সেজন্য দেশটিকে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর বড় কারণ চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা রয়েছে।
চীন অনেক পণ্যের কাঁচামালের বৈশ্বিক সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে কভিড-১৯ মহামারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাকি বিশ্বকে রূঢ় বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়েছে। এদিকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে চীন অবকাঠামো নির্মাণে তার বিশাল আর্থিক সম্পদ ও সামর্থ্য ব্যবহার করছে। দেশটি এখন প্রতিরোধমূলক সামরিক ক্ষমতার অধিকারী, মহাকাশভিত্তিক প্রযুক্তি, সামুদ্রিক শক্তি ও পারমাণবিক অস্ত্র সম্প্রসারণ করছে।
এ প্রেক্ষাপট ভারতের জন্যেও প্রাসঙ্গিক। কারণ ভারতও আগামী বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক শাসন ব্যবস্থায় অগ্রণী ভূমিকার আসনে নিজেকে দেখতে চায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরতা বাড়িয়ে ভারত তার লক্ষ্য অর্জন করতে কতটা পারবে? এটি অনিবার্যভাবে ভারতের বৈদেশিক নীতির স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করবে। অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কম সমর্থনের বিনিময়ে ভারত পররাষ্ট্রনীতির স্বাধীনতা বজায় রাখবে যাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত লক্ষ্য অর্জন হবে; এটিই এখন বড় প্রশ্ন।
২০০৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে এবং এটি ধীরে ধীরে আরো শক্ত হয়। বর্তমানে আর কোনো দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এত বিস্তৃত নয়। যুক্তরাষ্ট্রই একক দেশ হিসেবে ভারতের ব্যবসা, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অংশীদার। ভারতের অর্থনীতিও মার্কিন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই ভারতের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার ধারণাগুলো প্রবাহিত হয়। একই হিসাব প্রতিরক্ষা বিষয়েও। মার্কিন প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ব্যাপক অধিগ্রহণ, মৌলিক চুক্তি স্বাক্ষর, সামরিক অনুশীলন কার্যক্রমের সম্প্রসারণ, দ্বিপক্ষীয়র পাশাপাশি বহুপক্ষীয় অনুশীলন, মার্কিন সেনাদের সামরিক ও দ্বিপক্ষীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুমতি, কৌশলগত ধারণা শেয়ার এবং কোয়াডের মতো ইন্দোপ্যাসিফিক ফোরামের সদস্য হওয়া। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় কর্তৃত্ববাদের উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি দেশই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের সঙ্গে ভারতের জনগণের সম্পর্কও গভীর। মার্কিন সমাজে ৪০ লাখ ভারতীয় যার মধ্যে প্রায় দুই লাখ ভারতীয় শিক্ষার্থী রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের শক্তিশালী একাডেমিক বন্ধন বিদ্যমান।
একই সঙ্গে দেশটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়েনও রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থী সংবাদপত্রগুলো পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদনের মাধ্যমে ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরিতে অবদান রাখে। মার্কিন মানবাধিকার সংস্থাগুলো সংখ্যালঘু, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র বিষয়ে ভারতকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করেছে মার্কিন আইন। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান নীতি ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থকে উপেক্ষা করেছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রতি নরম নীতি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চীনের সঙ্গে লাদাখ সীমান্ত বিরোধ নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে কূটনৈতিক সমর্থন দেয়, কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করে এবং কিছু গোয়েন্দা তথ্য প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত বন্ধনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র সমুদ্র অঞ্চলে। সন্দেহ নেই এটি আমাদের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা চীনের সামুদ্রিক সক্ষমতা বাড়ছে, দ্বিপক্ষীয় ও ইন্দোপ্যাসিফিক ধারণা এবং কোয়াডের মাধ্যমে এসব স্বার্থ হাসিল করতে হবে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের এ সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে। জেনে রাখা উচিত যে চীনের সঙ্গে ভারতের স্থলভিত্তিক সংঘর্ষের ক্ষেত্রে মার্কিন সমর্থন সামান্যই মিলবে।
আফগানিস্তানের সংকেত পরিষ্কার। লাদাখের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থান নিচ্ছে না। এমনকি পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরেও যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষ নিচ্ছে না, যদিও এসব ক্ষেত্রে তার মিত্রদের স্বার্থ রয়েছে, যেখানে ভারত একা নয়। ভারত মহাসাগরের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গী খুঁজছে ভৌগোলিক অবস্থান এবং নৌবাহিনীর শক্তি বিবেচনায়, যা দিতে পারে ভারত। এ বিষয়ে ভারত এরই মধ্যে তার চাওয়ার বিস্তৃতি ঘটিয়েছে, ভারত মহাসাগরে ফ্রান্সের সহযোগী হয়েছে। চীনের সম্প্রসারণ ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশল উন্নয়নে বিস্তৃত সহযোগিতার সঙ্গী হয়েছে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়