সংখ্যাগত দিক থেকে গরু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১২তম। তবে গড় উৎপাদনশীলতায় এখনো অনেক পিছিয়ে। প্রতিনিয়ত দেশের জনসংখ্যা বাড়লেও চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনশীলতা না বাড়ায় বাজারে গরুর মাংসের দাম বেড়ে চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সংকটে দেশে গরুর উৎপাদনশীলতা কম। এ বিষয়ে এখনই মনোযোগ না দিলে ভবিষ্যতে ভোক্তা চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হবে।
প্রাণিসম্পদ খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশে কৃষি খাতের গবেষণায় যথেষ্ট কাজ হলেও প্রাণিসম্পদ খাত এখনো পিছিয়ে। প্রথাগত পদ্ধতিতে গরু উৎপাদন ও খামার পরিচালনা করে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব নয়। উন্নত দেশগুলোর ফার্মিং পদ্ধতি অনুসরণ করে বিজ্ঞানভিত্তিক খামার গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ নিতে হবে। জাত উন্নয়ন ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো অবদান রাখতে হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে গরুর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩৩ লাখ। এর পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে গরুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ কোটি ৪০ লাখ ৮৬ হাজার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ২ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৪৩ লাখ ৯১ হাজার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ কোটি ৪৫ লাখ ৪৫ হাজার এবং সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে গরুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ কোটি ৪৭ লাখ। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে দেশে গরু বেড়েছে মাত্র সাড়ে ১৩ লাখ। আর পাঁচ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। ২০১১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী সে সময় জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ। অর্থাৎ ১১ বছরের ব্যবধানে জনসংখ্যা বেড়েছে আড়াই কোটির বেশি। আর ২০০১ সালে দেশে জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৪৩ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে জনসংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে গরু বাড়ছে না। বাড়ছে না গরুর উৎপাদনশীলতাও। গরুর ক্ষেত্রে সংখ্যাগত দিক বিবেচনায় শীর্ষ ১২তম অবস্থানে থাকলেও উৎপাদনশীলতায় অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। এ কারণে প্রতিনিয়ত গরুর দাম বাড়ছে। আবার খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশে অনেক খামারি তাদের খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। মোট জবাই হওয়া গরুর প্রায় অর্ধেকই মূলত কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে জবাই হয়। এখনই জাত উন্নয়ন করা না গেলে ভবিষ্যতে গরুর মাংসের চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বের বিভিন্ন পরিসংখ্যানের তথ্য প্রকাশ করে অনলাইনভিত্তিক প্রকাশনা আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা। তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বে একটি গরু থেকে পাওয়া গড় মাংসের পরিমাণ ২১৮ কেজি। অন্যদিকে বাংলাদেশে একটি গরু থেকে মাংসের পরিমাণ গড়ে মাত্র ৭১ কেজি। অর্থাৎ বৈশ্বিক গড় উৎপাদনশীলতার চেয়ে বাংলাদেশে গরুর উৎপাদনশীলতা তিন ভাগ কম। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৭০ কেজি, চীনে ১৪৮, ভারতে ১০৩, ব্রাজিলে ৩৫১, পাকিস্তানে ১৩০ ও রাশিয়ায় উৎপাদনশীলতা ২১৩ কেজি। সংস্থাটি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বরাতে এ তথ্য প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এ দেখা যায়, বর্তমানে দেশে একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে মাংস খায় ৪০ গ্রাম। এর মধ্যে শহরে মাংস খাওয়ার হার ৫০ দশমিক ৩ গ্রাম আর গ্রামে মাংস খাওয়ার হার ৩৫ দশমিক ৪ গ্রাম। ২০১৬ সালে মাংস খাওয়ার হার ছিল ২৫ দশমিক ৪ গ্রাম। আর ২০১০ সালে মাংস খাওয়ার হার ছিল ১৯ গ্রাম করে। অর্থাৎ ১০ বছরে মাংস খাওয়ার হার বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
বর্তমানে রাজধানীতে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৮০০ টাকায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছর এ সময়ে রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ৬৫০-৬৮০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কেজিতে ১০০-১২০ টাকা দাম বেড়েছে।
মূলত উৎপাদনশীলতা না বাড়ায় মাংসের দাম বাড়ছে বলে মনে করেন বেঙ্গল মিটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আ ফ ম আসিফ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে উৎপাদনশীলতা অন্যান্য দেশের চেয়ে কম। যেভাবে গরুর মাংসের দাম বাড়ছে, তাতে সাধারণভাবেই বলা যায়, চাহিদা অনুযায়ী আমাদের সরবরাহ বেড়ে ওঠেনি। কৃষি খাতে বাংলাদেশে যে বিপ্লব হয়েছে, সেখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবন। কিন্তু প্রাণিসম্পদে এখনো প্রথাগত পদ্ধতিতেই নির্ভর করতে হচ্ছে। উদ্ভাবনে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। কৃষি খাতে গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রাণিসম্পদ খাতে সেভাবে উদ্ভাবন এখনো হয়নি।’
বিজ্ঞানভিত্তিক ফার্মিংয়ে গুরুত্ব দিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের ভাতের জোগান দিচ্ছেন কৃষক। এটা কৃষক একা করেননি। প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ভাবনের কারণেই সম্ভব হয়েছে। উদ্ভাবনগুলো পরিকল্পনামাফিক সম্প্রসারণ হয়েছে। অনেক তরুণ উদ্যোক্তা বড় খামার করছেন। কিন্তু তাদের ফার্মিং টেকনিকে বড় কোনো পরিবর্তন নেই। এর মাধ্যমে শুধু সংখ্যাগত বৃদ্ধিই হচ্ছে। প্রযুক্তিগত ব্যবহারে তারা পিছিয়ে। যেহেতু জমি কম, তাই আমাদের দেশে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে অবশ্যই জোর দিতে হবে। আর তা হতে হবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে। উন্নত দেশগুলোয় ফার্মিংয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ফার্মিংটা একদমই প্রথাগত। খামারিরা যতটুকু চেষ্টা করছেন ততটুকুই।’
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য বলছে, সারা বিশ্বে ২০২০ সালে প্রায় ১৪৬ কোটি ৮০ লাখ গরু পালিত হয়েছে। এর মধ্যে ২১ কোটি ১৭ লাখ পালনের মাধ্যমে শীর্ষে রয়েছে ব্রাজিল। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারত ১৮ কোটি ৯০ লাখ, তৃতীয় অবস্থানে থাকা চীন ১১ কোটি ৩৫ লাখ, চতুর্থ অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র ৮ কোটি ৯২ লাখ ও পঞ্চম অবস্থানে থাকা ইথিওপিয়ায় ৫ কোটি ৪০ লাখ গরু পালন হয়েছে। এছাড়া পালন হওয়া গরুর সংখ্যায় শীর্ষ ১৫-তে থাকা অন্য দেশগুলোর মধ্যে আর্জেন্টিনায় ৫ কোটি ১০ লাখ, সুদানে ৪ কোটি ১৯ লাখ, পাকিস্তানে ৩ কোটি ৮২ লাখ, মেক্সিকোয় ৩ কোটি ২৪ লাখ, অস্ট্রেলিয়ায় ২ কোটি ৯২ লাখ ও তানজানিয়ায় ২ কোটি ৪৫ লাখ গরু পালিত হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে পরিসংখ্যানের তথ্যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও এর প্রভাব পড়ছে। এছাড়া উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিজ্ঞানভিত্তিক ফার্মিংয়ে মনোযোগ বাড়াতে হবে। আর জাত উন্নয়নেও এখনই নজর না দিলে ভবিষ্যতে দেশের মানুষের মাংসের চাহিদা পূরণে সংকট দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি খামারিদের সুরক্ষায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) তথ্যমতে, সারা দেশে ছোট-বড় ১০ লাখের বেশি ডেইরি ও ফ্যাটেনিং খামার রয়েছে। এর মধ্যে করোনা মহামারী ও পশুখাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে প্রায় ১৫-২০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে প্রচলিত পশুখাদ্যের উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে সয়াবিন খৈল, গমের ভুসি, রাইস পলিশ, মসুর ভুসি, সরিষার খৈল, ভুট্টা, মুগ ভুসি ও মটর ভুসি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে গমের ভুসি, রাইস পলিশ, মসুর ভুসি, ভুট্টা ভাঙা, মুগ ভুসি ও মটর ভুসির দাম প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। আর সয়াবিন খৈল ও সরিষার খৈলের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে অনেক উদ্যোক্তাই খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়