উত্তরে হিমালয় পর্বত। পশ্চিমে হিন্দুকুশ ও পূর্বে আরাকানি পর্বতমালা। দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। এর মধ্যকার অঞ্চলটির ভৌগোলিক পরিচিতি ‘দক্ষিণ এশিয়া’ হিসেবে। যুগ যুগ ধরে একে ভারতীয় উপমহাদেশ হিসেবেও লেখা হয়েছে। আনুমানিক প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে ইউরেশীয় প্লেটের সঙ্গে উত্তরমুখী ইন্ডিয়ান প্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে এশিয়ার অংশ হয় ভূখণ্ডটি।
বর্তমানে মূল ভূখণ্ডে অঞ্চলটি বিভক্ত হয়েছে পাঁচটি দেশে—বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটান। এর বাইরে দ্বীপদেশ শ্রীলংকা ও মালদ্বীপও ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্ভুক্ত। ভারত ছাড়া অন্য ছয় দেশের মানুষের মধ্যেই এ অঞ্চলকে ভারতীয় উপমহাদেশ হিসেবে উল্লেখ করার ক্ষেত্রে কম-বেশি অস্বস্তি দেখা যায়। এ অস্বস্তি খুব বেশিদিনের পুরনো নয়। মাত্র কয়েক দশকের। এর কারণটাও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক।
বিশেষ করে পাকিস্তানি ও নেপালিদের মধ্যে এ অঞ্চলকে ভারতীয় উপমহাদেশ বা ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট হিসেবে উল্লেখ করার ক্ষেত্রে ঘোর আপত্তি দেখা যায়। এক্ষেত্রে তাদের মনোভাব হলো এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে ভারতের আধিপত্য বিস্তারের ক্রমবর্ধমান খায়েশকে আরেকটু উসকে দেয়া হয়।
অন্যদিকে ভারতীয়দের মধ্যে আপত্তি রয়েছে ‘দক্ষিণ এশিয়া’ নিয়ে। তাদের মতে, এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে ভারতের ঐতিহাসিক ও বর্তমান ভূমিকাকে অস্বীকার করা হয়।
পণ্ডিত মহল বলছে, সংস্কৃতি ক্রমপরিবর্তনশীল। কোনো এক দেশ বা অঞ্চলের গণ্ডিতে একে আটকে রাখা যায় না। এমনকি কোনো এক দেশ বা অঞ্চলকে এর একক উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। এ কারণে আধুনিককালের জটিল রাষ্ট্র ও আরোপিত মানচিত্র দিয়ে সভ্যতা বা সংস্কৃতির সংজ্ঞায়ন করাটাও অসম্ভব।
আঞ্চলিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিচয়ের মধ্যকার এ সংকট মাঝেমধ্যে বিরোধেরও জন্ম দেয়। নেপালি ও ভারতীয়দের মধ্যে বর্তমানে বিতর্ক চলছে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান নিয়ে। গৌতম বুদ্ধকে ভারতীয় বলা হলে বিরক্ত হচ্ছে নেপালিরা।
এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো গৌতম বুদ্ধের জন্ম খ্রিস্টেরও কয়েক শতক আগে। সে সময় ভারত নামে আলাদা কোনো সার্বভৌম রাজনৈতিক অস্তিত্ব ছিল না। তার জন্ম হয়েছিল লুম্বিনিতে, যা এখন নেপালের অংশ।
তবে এ যুক্তিও বেশিক্ষণ ধোপে টেকে না বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সে সময় নেপাল নামেও কোনো দেশের অস্তিত্ব ছিল না। ইতিহাস বলছে, গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল শাক্যবংশ শাসিত রুম্মিনিদাই নামে রাজ্যে। আজকের গণপ্রজাতন্ত্রী নেপালের লুম্বিনিকেই রুম্মিনিদাই হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে গৌতম বুদ্ধের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে উত্তর ভারত অঞ্চলে। তার বোধিপ্রাপ্তি থেকে দেহাবসান পর্যন্ত সবই ঘটেছে ওই এলাকায়।
গত শতকের আগ পর্যন্ত পৃথিবীর মানচিত্রে ভারত নামের কোনো দেশের অস্তিত্ব ছিল না। গৌতম বুদ্ধের আমলে গোটা উপমহাদেশই বিভক্ত ছিল ছোট ছোট বেশ কয়েকটি রাজ্যে। এসব রাজ্যের ভাষা, সংস্কৃতি, দর্শন ও আচার-আচরণে পার্থক্য থাকলেও সবগুলোকেই মোটা দাগে একত্রে ‘ভারতীয়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গোটা অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে গড়ে দেয়া সভ্যতাগুলোকেও আখ্যা দেয়া হয়েছে ভারতীয় সভ্যতা হিসেবে।
অন্যদিকে এসব সভ্যতার ইতিহাসকে শুধু দক্ষিণ এশীয় সভ্যতা হিসেবে আখ্যা দেয়াটাও ভুল হবে। এর কারণ হলো এসব সভ্যতা শুধু উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের জন্ম উপমহাদেশে। কিন্তু এ ধর্মের বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে মধ্য এশিয়াতেও। একই সঙ্গে সনাতন ধর্মেরও বিস্তার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ঘটেছিল।
পণ্ডিতরা বলছেন, কোনো সংস্কৃতিতেই কোনো একক অঞ্চল বা দেশের একক অধিকার থাকে না। এর অন্যতম বড় উদাহরণ হলো বাংলা ভাষা। এ বিষয় তাদের বক্তব্য হলো প্রায় ২৫ কোটি মানুষের ভাষা বাংলা। মূলত দুই দেশের নাগরিক এ ভাষায় কথা বলে—বাংলাদেশ ও ভারত। বাংলাভাষীদের সবচেয়ে বড় অংশটির বসবাস বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলার ওপর একক অধিকার শুধু বাংলাদেশীদের নয়। দুই দেশের বাংলাভাষীদের সবারই এ ভাষার ওপর দাবি রয়েছে। এ কারণে শুধু বাংলাদেশীদের বাঙালি হিসেবে অভিহিত করতে যাওয়াটাই ভুল।
একই সঙ্গে উদাহরণ হিসেবে আসছে প্রাচীন বঙ্গ জনপদের কথাও। বাংলাদেশের খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর ও প্রেসিডেন্সি বিভাগের একাংশকে মহাভারতে উল্লিখিত জনপদটির অবস্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ কারণে শুধু বাংলাদেশ বা শুধু পশ্চিমবঙ্গকে বৈদিক আমলের বঙ্গ জনপদের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে দাবি করা ভুল হবে বলে অভিমত পণ্ডিতদের। একই কথা বলা চলে প্রাচীন বাংলার জনপদ প্রাগজ্যোতিষ ও পুণ্ড্রবর্ধনের ক্ষেত্রেও।
অন্যদিকে নেপাল ও ভুটানের বর্তমান সংস্কৃতিকে শুধু ভারতীয় সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বলা চলে না। এতে প্রভাব রয়েছে তিব্বতি সংস্কৃতিরও। বিশেষ করে ভুটানের ক্ষেত্রে এ প্রভাব সবচেয়ে বেশি। একইভাবে ভারতের লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশেও তিব্বতি সংস্কৃতির ছাপ পাওয়া যায়।
উপমহাদেশের দেশগুলো অতীতে একত্রে যুক্ত হয়ে একাধিকবার বড় সাম্রাজ্য গঠন করেছে। আবার আলাদা হয়ে একে অন্যের মুখোমুখিও হয়েছে অসংখ্যবার। আবার বৈদিক যুগ থেকেই এ অঞ্চল বারবার বহিঃশক্তির আক্রমণেরও শিকার হয়েছে। সাম্রাজ্য ভাঙাগড়ার খেলায় বিজয়ী সংস্কৃতি সব সময়ই চড়াও হয়েছে পরাজিতের ওপর। কখনো কখনো নিজেও পরাজিত সংস্কৃতির কাছ থেকে ধার করেছে। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো অনেক রীতিনীতির সন্ধান পাওয়া যায়, যার প্রকৃত উৎস এ অঞ্চলের আদিবাসীদের জীবনাচার।
আবার সংস্কৃতির শান্তিপূর্ণ রূপান্তরও ঘটেছে। ব্যবসার স্বার্থে বণিক এসেছে। ধর্মপ্রচারের স্বার্থে এসেছে সাধক। তারা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে নতুন সংস্কৃতি। সেসব সংস্কৃতিকে আবার নিজস্ব বাস্তবতা ও জীবন-জীবিকার সঙ্গে উপযোগী করে নিয়েছে স্থানীয়রা। এসব কিছু মিলিয়ে গোটা উপমহাদেশের সবখানেই সংস্কৃতি ভেঙেছে-গড়েছে বারবার। আবার এখানকার সংস্কৃতিও ছড়িয়েছে এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে।
এই বিভাগের আরও খবর
ট্রেন্ডিং
সর্বাধিক পঠিত
- সাতক্ষীরা জেলার দুজন সাংসদকে মন্ত্রী দাবি
- বড় চমক থাকছে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে
- চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি
- একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে ৩০ জানুয়ারি
- ওয়ালটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডোর হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি
- ঘুরে আসুন সাদা পাথরের দেশে
- অ্যাশ-ম্যাশের স্বাগত খুনসুটি
- শেখ হাসিনার যত রেকর্ড
- ঘুরে আসুন সিকিম
- ভোটারদের সঙ্গে সালমানের শুভেচ্ছা বিনিময়